গ্রামে বেশ সাড়া পড়ল বলে মনে হল। খোন্দকার সাথের একটা গরু জবাইয়ের ব্যবস্থা করলেন। চমচম আনতে লোক চলে গেল। খোন্দকার সাহেব বললেন, মতি আস্ত গরু খেতে পারবি? বিশিষ্ট মেহমান আছে। তাঁর সামনে একটা রেকর্ড হয়। ঢাকায় ফিরে উনি কাগজে লিখে দেবেন।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আস্ত গরু খাবার দরকার নেই। একটা কেলেংকারী হবে।
আরে না, মতিকে আপনি চেনেন না। ও ইচ্ছা করলে হাতী খেয়ে ফেলতে পারে। বিরাট খাদক। অতি ওস্তাদ লোক।
এ রকম ওস্তাদ বেশী না থাকাই ভাল। খেয়েই সব শেষ করে দেবে।
আরে না, খাওয়াবে কে বলেন ভাই? খাওয়ানোর লোক আছে? লোক নেই। খাওয়া-খাদ্যও নেই। এই যে গরু জবাই দিলাম তার দাম তিন হাজার টাকা। দেশের অবস্থা খুব খারাপরে ভাই।
রান্নার আয়োজন চলছে। মতি মিয়া বসে আছে আমার সামনে। হাসি হাসি মুখে। মাঝে মাঝে বিড়ি খাবার জন্যে বারান্দায় উঠে যাচ্ছে আবার এসে বসছে। আমি বললাম, এত যে খান, খাওয়ার টেকনিকটা কি?
মতি মিয়া নড়েচড়ে বসল, উৎসাহের সঙ্গে বলল–গোশত চিপা দিয়া রস ফেলাইয়া দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর পর একটু কাঁচা লবণ মুখে দিতে হয়। পানি খাওয়া নিষেধ।
তাই নাকি?
জ্বি। আর চাবাইতে হয় খুব ভাল কইরা। গোশত যখন মুখের মধ্যে তুলার মত হয় তখন গিলতে হয়।
কায়দা কানুনতো অনেক আছে দেখি।
বসারও কায়দা আছে। বসতে হয় সিধা হইয়া যেন পেটের উপর চাপ না পড়ে।
এই সব শিখেছেন কোত্থেকে?
নিজে নিজে বাইর করছি জনাব। ওস্তাদ কেউ ছিল না। আমারে তুমি কইরা বলবেন। আমি আপনার গোলাম।
মতি মিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে নানান ধরনের গল্প শুরু করল। সবই খাদ্য বিষয়ক। দু’বছর আগে কোন এক প্রতিমন্ত্রী নাকি নেত্রকোনা এসেছিলেন। মতি মিয়া তার সামনে আধমণ জিলেপী খেয়ে তাঁকে বিস্মিত করেছে।
খাইতে খুব কষ্ট হইছে জনাব।
কষ্ট কেন?
জিলাপীর ভিতরে থাকে রস। রসটা গণ্ডগোল করে।
মন্ত্রী সাহেব খুশী হয়েছিলেন?
জ্বি খুব খুশী। ছবি তুলেছিলেন। দুইশ টেকাও দিছেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। বলছিলেন ঢাকায় নিয়া যাবেন, পেসিডেন সাহেবের সামনে খাওনের ব্যবস্থা করবেন। পেসিডেন সাবরে খুশি করতে পারলে কপাল ফিরত। কথা ঠিক না?
খুব ঠিক। আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব কবি মানুষ। খুশী হলে হয়তো আপনাকে নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলতেন। মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
আমি বললাম, আপনার ছেলেমেয়ে কি? তারাও কি খাদক নাকি?
জ্বি না। তারা না-খাওন্তির দল। খাইতে পায় না। কাজ কামতো কিছু করি না, খাওয়ামু কি? তারা হইল গিয়ে আফনের দেখক।
সেটা আবার কি?
তারা দেখে। আমি যখন খাই,তখন দেখে। দেখনের মধ্যেও আরাম আছে।
মতি মিয়া বিমর্ষ হয়ে পড়ল। এই প্রথম বারান্দায় না গিয়ে আমার সামনেই বিড়ি ধরিয়ে খক খক করে কাশতে লাগল।
খাওয়া শুরু হল রাত দশটার দিকে। একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে উঠোনে খাবার আয়োজন হয়েছে। এই প্রচণ্ড শীতে কাঁথা গায়ে গ্রাম ভেঙ্গে লোকজন এসেছে। মতি মিয়া খালি গায়ে আসনপিড়ি হয়ে বসেছে। ধ্যানস্থ মূর্তির মতি মিয়ার ছেলেমেয়েগুলিকেও দেখলাম। পেট বের হওয়া হাড় জিরজিরে কয়েকটি শিশু। চোখ বড় বড় করে বাবার খাবার দেখছে। শিশুগুলি ক্ষুধার্ত। হয়ত রাতেও কোন কিছু খায় নি। মতি একবারও তার বাচ্চাগুলির দিকে তাকাচ্ছে না।
খোন্দকার সাহেব গ্রামের বিশিষ্ট কিছু লোকজনকে এই উপলক্ষে দাওয়াত করেছেন। স্কুলের হেডমাষ্টার, গ্রামীন ব্যাংকের ম্যানেজার, থানার ওসি সাহেব, পোষ্টমাষ্টার সাহেব। সামাজিক মেলামেশার একটি উপলক্ষ। বিশিষ্ট মেহমানদের জন্যে খাসী জবেহ হয়েছে। দস্তরখানা বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আলোচনার প্রধান বিষয় ইলেকশন। ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খোন্দকার সাহেব ইলেকশনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। এর আগেরবার হেরেছেন। এবার হারতে চান না। জিততে চান। এবং দেশের কাজ করতে চান।
অতিথিরা রাত বারটার দিকে বিদেয় হলেন। আঁকিয়ে শীতে পড়েছে। মতি মিয়াকে ঘিরে যারা বসে আছে তাদেরকে শীতে কাবু করতে পারছে না। খড়ের আগুন করা হয়েছে। সেই আগুনের চারপাশে সবাই বসে। শুধু মতি মিয়ার। ছেলেমেয়েরা তার বাবার চারপাশে বসে আছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার বাবার খাওয়া দেখছে। মতি মিয়া ফিরেও তাকাচ্ছে না। তার গা দিয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে। চোখ দু’টি মনে হচ্ছে একটু ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। আমার মনে হয় পিতলের এই বিশাল হাঁড়ির মাংস শেষ করবার আগেই লোকটা মারা যাবে। আমি হব মৃত্যুর উপলক্ষ। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটাই কুৎসিত। একদল ক্ষুধার্ত মানুষ একজনকে ঘিরে বসে আছে। সে খেয়েই যাচ্ছে।
খোন্দকার সাহেব এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, কেমন দেখছেন?
ভালই।
বলছিলাম না বিরাট খাদক।
তাইতো দেখছি।
শুয়ে পড়েন। শেষ হতে দেরী হবে। সকাল দশটার আগে শেষ হবে না। এখন খাওয়া স্লো হয়ে যাবে।
তাই নাকি?
জ্বি। শেষের দিকে এক টুকরা গোশত গিলতে দশ মিনিট সময় নেয়।
আমি মতির দিকে তাকিয়ে বললাম, কি মতি খারাপ লাগছে?
জ্বে না।
খারাপ লাগলে বাদ দাও। বাকিটা তোমার বাচ্চারা খেয়ে নেবে।
খোন্দকার সাহেব বললেন, অসম্ভব–একটা রেকর্ড করছে দেখছেন না? তুমি চালিয়ে যাও মতি। ভাই, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
আমি শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে অনেক চেষ্টা করলাম মতি মিয়ার চরিত্রে কিছু মানবিক গুণ ঢুকিয়ে দিতে। নানাভাবেই তা সম্ভব। রাত একটার দিকে যদি মতি মিয়া ঘোষণা করে বাকি গোশত আমি আর খাব না। হার মানলাম। এখানে যারা আছে তারা খাক। তাহলেই হয়।