টাকাটা পাওয়া গেলে মাস ছয়েকের জন্য নিশ্চিন্ত। শ্যামগঞ্জ বাজারের মেয়ে মানুষটার কাছেও তাহলে ইজ্জত নিয়ে যাওয়া যাবে। মেয়ে মানুষটা বড় তুচ্ছ করছে। গত মাসে একবার গিয়েছিল, দরজা ধরে কঠিন গলায় বলল, আইজ যান গিয়া ঘরে লোক আছে।
হানিফ আবার সিগারেট ধরাল। আর একটা মাত্র বাকি আছে। শেষ সিগারেটটা ধরানো যাবে না। কাজের শেষে একটা সিগারেট ধরাতেই হয়। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সিগারেটের আগুন খুব সাবধানে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে। বৃষ্টির ফোটায় আগুন নিভে গেলে সিগারেট আর ধরানো যাবে না। রাতের ট্রেন আসতে আজ এত দেরী করছে কেন কে জানে। লোকাল ট্রেইনগুলির আসা যাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। খুব বেশী দেরী করলে রইসুদ্দিন নামের রোগা কঞ্জুষ লোকটা হয়ত আসবেই না। বারহাট্টায় আত্মীয় বাড়িতে থেকে যাবে। আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। এইসব কাজে অপেক্ষার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। একবার এই রকম একটা কাজে এগারোদিন অপেক্ষা করা লাগলো। লোকটাকে কিছুতেই একা পাওয়া যায় না। সঙ্গে সব সময় একজন না একজন থাকে। অতি সাবধানী লোক। এত সাবধান হয়েও অবশ্যি শেষ রক্ষা হয়নি। কপালে মরণ লেখা থাকলে সাবধান হয়েও লাভ হয় না। লখিন্দর লোহার ঘর বানিয়েও বাঁচতে পারে নি।
এই লোক অবশ্যি সাবধানী না। একা একাই ঘুরা ফিরা করে। তার এত বড় একজন শত্রু আছে তা বোধহয় জানেও না। না জানাই ভাল। জানলে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। মৃত্যু ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। তাছাড়া মরাটা ভয়াবহ কিছু না। একদিন না একদিন সবাইকেই মরতে হবে। রোগে ভুগে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে মরার চেয়ে এইভাবে মরে যাওয়া ভাল। কষ্ট অনেক কম। মৃত্যুর পর শহীদের দরজা পাওয়ারও একটা সম্ভাবনা থাকে। অপঘাতে মৃত্যু হলে শহীদের দরজা পাওয়া যায়–মৌলানা সাহেব একবার ওয়াজে বলেছিলেন। অপঘাতে মৃত্যু আর পেটের অসুখে মৃত্যু। এই দুয়ের জন্যে আছে শহীদের দরজা। মওলানা সাহেবদের সব কথা কেন জানি বিশ্বাস হতে চায় না। পেটের অসুখে মৃত্যু হলে শহীদের দরজা পাওয়া যাবে কি জন্যে? কারণটা কি? সত্যি হলে অবশ্যি ভালই হয়। তাহলে বড় মেয়েটা শহীদের দরজা পায়। মেয়েটা মারা গেল পেটের ব্যাথায়। কোন চিকিৎসা করতে পারে নি। কি চিকিৎসা। করাবে, হাতে নাই একটা পয়সা। মেয়েটা ছটফট করেছে আর বলেছে–বাজান আমারে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাও।
হানিফ নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বলেছিলেন–পেট কাটা লাগবে। তিন হাজার টাকা খরচ হবে কমসে কম। আছে টাকা? না থাকলে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দে।
হানিফ তাও পারেনি। মেয়েটা কোলের উপর ছটফট করতে করতে মরল। বড় মেয়েটার মৃত্যুর পর মানুষ মারার প্রথম কাজটা হানিফ করে। যে মানুষটাকে প্রথম মারে তার নাম ছিল দবীর। মরার সময় সেও অবিকল তার মেয়ের মত ছটফট করতে করতে হানিফকে বলল, আফনে আমারে ডাক্তারের কাছে লইয়া যান।
কি আশ্চর্য কথা। যে তার পেটে ছোরা বসিয়েছে তাকেই অনুরোধ করছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। মৃত্যুর সময় মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা করে। কেন করে কে জানে? একবার এক লোকের পেটে ছোরা বসাবার পর দু’হাতে পেট চেপে বসে পড়তে পড়তে খুবই অবাক হওয়া গলায় জিজ্ঞেস করেছিল — ভাইজান আপনের নাম কি?
মৃত্যুর সময় মানুষের মাথায় বোধহয় কিছু একটা হয়। সব গোলমাল হয়ে যায়। তার বড় মেয়েরও তাই হয়েছিল। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল–বাজান আপনে হাসতাছেন ক্যান? কি হইছে?
হানিফ তখন হাসছিল না। চিৎকার করে কাঁদছিল। সেই কান্না মৃত্যুর সময় মেয়েটার কাছে হাসি হয়ে ধরা পড়ল।
পিঁপড়া কামড়াচ্ছে।
রাতে পিঁপড়া কামড়ায় না, কিন্তু এখন কামড়াচ্ছে কেন কে জানে? হানিফ ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এল। প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল রইসুদ্দিন আসছে। পা টেনে টেনে আসছে।
হানিফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। শেষ সিগারেটটা রয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ধরানো যাবে। তবে দিয়াশলাই ভিজে গেছে। ভেজা দেয়শলাই দিয়ে এ সিগারেট ধরানো সমস্যা হতে পারে, এই নিয়েই সে খানিকটা চিন্তিত এবং বিষণ্ণ।
খাদক
আমি লোকটির বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করছি। তার তেমন প্রয়োজন ছিল না। লোকটির বয়সে আমার কিছু যায় আসে না। তবু প্রথম দর্শনেই কেন যেন বয়স জানতে ইচ্ছে করে। তবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, লোকটিকে বেশ ঘটা করে আনা হয়েছে। দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে আমার সামনে। আমাদের ঘিরে মোটামুটি একটা ভিড়। লোকটি জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। সেই হাসির আড়ালে গোপন একটা অহংকারও আছে। কিসের অহংকার কে জানে।
খোন্দকার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বললেন–এই সেই লোক।
আমি বললাম, কোন লোক?
খাদক।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, খাদক মানে?
খোন্দকার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এর মধ্যেই ভুলে গেছেন? রাতে আপনাকে বললাম না–আমাদের গ্রামে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আছে। নাম করা খাদক।
আমার কিছুই মনে পড়ল না। খোন্দকার সাহেব লোকটি ক্রমাগত কথা বলেন। তার সব কথা মন দিয়ে শোনা অনেক আগেই বন্ধ করেছি। কাল রাতে খাদক খাদক বলে কি সব যেন বলছিলেন। এ-ই তাহলে সেই বিখ্যাত খাদক।