পায়ের কাছে মড়মড় শব্দ হল। হানিফ চমকে খানিকটা সরে গেল। সাপ-খোপ হতে পারে। ভাদ্র মাস হল সাপের মাস। গরমে অতিষ্ট হয়ে তারা গর্ত ছেড়ে বের হয়। হানিফের সঙ্গে একটা টর্চ আছে। আলো ফেলে দেখবে না-কি ব্যাপারটা কি?, সেটা ঠিক হবে না। আশে পাশে কেউ নেই। টর্চ জ্বালালেও কোন ক্ষতি হবে না, তবু সাবধান থাকা ভাল। পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে। কতক্ষণ ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তা নিজে ধরতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সময় কাটছেই না, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় অতি দ্রুত কেটে যাচ্ছে।
হানিফ বসল।
হাতের আঙ্গুলে আগুন আড়াল করে সিগারেট ধরাল। পকেটে দশটা সিগারেট নিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, এখন সিগারেট আছে তিনটা। সাতটা এর মধেই খাওয়া হয়ে গেছে। এর থেকে মনে হচ্ছে রাত কম হয়নি। হানিফ রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছল। অন্য সময়ে এতটা ঘামে না। আজ বড় বেশী ঘামছে। মুখের ভেতরটাও নোনতা লাগছে। মানুষের মুখের ভেতরেও কি ঘাম হয়? মনে হয়, হয়। না হলে মুখের ভেতর নোনতা লাগত না।
ঘুট ঘুটে অন্ধকার।
কৃষ্ণপক্ষের রাত, অন্ধকার হবেই। আকাশে মেঘ থাকায় নক্ষত্রের আলোও নেই। খুন করার জন্যে সময়টা ভাল না। এই রকম অন্ধকার রাতে ভুল ভ্রান্তি হয়। ভুল লোক মারা পড়ে। চাঁদনি রাতে হলে ভুল ভ্রান্তি হয় না। কে আসছে দূর থেকে দেখা যায়। সবচে ভাল হয় দিনের বেলা। তবে এই জাতীয় কাজ-কর্ম দিনের আলোয় হয় না বললেই হয়।
কৃষ্ণপক্ষে কাজ করতে হবে বলেই হানিফ গতকাল সন্ধ্যায় দুই ব্যাটারীর এই টর্চ লাইটটা কিনেছে। কাজ করার আগে মুখে আলো ফেলে দেখে নিতে হবে লোক ঠিক আছে কি-না। একবার আলো ফেললেই চিনতে পারবে। আলো না-ফেলে হটা দেখেও চিনতে পারবে–লোকটা হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ডান পায়ে কোন দোষ টোষ মনে হয় আছে।
লোকটাকে সে যাতে চট করে চিনতে পারে সেই উদ্দেশ্যে গতকাল তার সঙ্গে আলাপও করেছে। লোকটা প্রতিদিন ভোর আটটার ট্রেনে মোহনগঞ্জ থেকে যায় বারহাট্টা, ফিরে রাত দশটার ট্রেনে। দলিল লেখক। দলিল লেখকরা সাধারণত হতদরিদ্র হয়,এ সেই শ্রেণীর না। এর পয়সা কড়ি ভাল আছে। বাড়িতে টিনের বড় বড় দুটো ঘর। বাংলাঘরের পশ্চিমদিকে টিউবওয়েল। লম্বা বাঁশের আগায় এন্টেনা দেখে বোঝা যায় টেলিভিশন আছে। নিশ্চয়ই ব্যাটারীতে চালায়। এই অঞ্চলে এখনো ইলেকট্রিসিটি আসে নি। ব্যাটারীতে টিভি চালানো খরচান্ত ব্যাপার। তবে লোকটা কঞ্জুষ ধরনের। গতকাল সকালে কিছুক্ষণ সঙ্গে থাকায় তার স্বভাব চরিত্র পরিষ্কার বোঝা গেছে। হানিফ ডিসট্রিক বোর্ডের সড়কে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। মোহনগঞ্জ রেলষ্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে যাবে, এতে চেহারাটা মনে গাথা হয়ে যাবে। অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হবে না।
লোকটা মাটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে উঠে এল। হানিফ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভাইজানের সঙ্গে ম্যাচবাক্স আছে? একটা সিগারেট ধরাব। রইসুদ্দিন সরু চোখে তাকাল। নিতান্ত অনিচ্ছায় দেয়াশলাই এর বাক্স বের করল। হানিফ তার সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। হাসি মুখে বলল, নেন ভাইজান, আপনেও একটা ধরান। লোকটা তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষের কাছ থেকে সিগারেট নিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বা দ্বিধা দেখাল না। কঞ্জুষ প্রকৃতির লোকজনের এই হচ্ছে লক্ষণ। যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে নেয়া।
হানিফ বলল, ইষ্টিশানের দিকে যান না-কি ভাইজান?
হুঁ।
আমি একজন চাউলের পাইকার। চাউল কিনতে আসছিলাম, দরে বনল না। এই দিকে চাইলের দর বেশী।
হুঁ।
লোকটা সব কথার জবাব এক অক্ষরে দিচ্ছে। কঞ্জুষ ধরনের মানুষদের এটাও একধরনের আচরণ। মুখের কথাও তাদের কাছে টাকা পয়সার মতন। সহজে খরচ করতে চায় না। লোকটা বাজারে ঢোকার মুখে এক খিলি পান কিনল। হানিফ সঙ্গে আছে একবার জিজ্ঞেস করল না পান খাবে কি-না।
অথচ কিছুক্ষণ আগেই তার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে বিনা দ্বিধায় খেয়েছে। আশ্চর্য লোক।
হানিফ দুপুরের দিকে রইসুদ্দিনের বাড়িতে গিয়েও উপস্থিত হল। এটা তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কাজ কর্ম করার আগে ঐ বাড়িতে একবার যাবেই। রইসুদ্দিনের বাড়ি ঘর তার পছন্দ হল। হিন্দু বাড়ির মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি। ফুটফুটে একটা সবুজ জামা পরা মেয়ে বাংলা ঘরের উঠান ঝাট দিচ্ছে। হানিফ মধুর গলায় বলল, ও মা তুমি এই বাড়ির?
হ।
আমার জন্য গেলাসে কইরা পানি আনতে তিয়াশ লাগছে।
মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। কেমন হেলতে দুলতে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। পঁাচ ছয় বছর বয়স হবে, কিন্তু পরিষ্কার কাজ কর্ম। কি সুন্দর করে উঠান ঝাট দিচ্ছে। মেয়েটি ফিরে এল খালি হাতে। চিকন সুরে বলল, চাপ কল থাইক্যা পানি খাইতে কইছে।
আচ্ছা আচ্ছা। তুমি চাপ কলে চাপ দেও আমি পানি খাই।
মেয়েটি খুব উৎসাহের সঙ্গে কলে চাপ দিয়ে পানি বের করল। মনে হল সে পানি বের করার কাজটায় খুব মজা পায়।
তোমার নাম কি গো?
ময়না।
বড় ভাল নাম–ময়না। রইসুদ্দিন সাব তোমার কে হয়?
বাজান হয়।
আচ্ছা আচ্ছা ভাল।
হানিফের একটু মন খারাপ হল। ঘটনা ঘটে গেলে এই মেয়ে নিশ্চয়ই ডাক ছেড়ে কাঁদবে। কাঁদলেও কিছু করার নেই। ঘটনা সে না ঘটালে অন্য কেউ ঘটাবে। ব্যাপার একই। মাঝখান থেকে এতগুলি টাকা হাতছাড়া হবে। টাকার খুবই দরকার। হাত এখন একেবারে খালি। তার বৌ খানিকটা সৌখিন ধরনের মেয়ে, অভাব সহ্য করতে পারে না। একবেলা উপাস দিলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে। ছেলে মেয়ে গুলোকে ধরে ধরে পিটায়। সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে করতে করতে বলে — সর, সর।