তোকে বলেছে কে?
হে নিজেই বলেছে। তওবা করলে জেবন শেষ এই জন্য।
বলিস কি?
হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
মাগরেবের নামাজের পর বদরুল আলম সাহেব ইউনুসকে দেখতে গেলেন।
ইউনুসের হাতের কাছে লাঠি। হারিকেন জ্বলছে।
কিরে তুই না-কি তওবা করস নাই?
ইউনুস চুপ করে রইল।
ক্যান করস নাই? আল্লাহর সাথে মশকরা? হারামজাদা, তুইতো বিরাট বদ।
ইউনুস ক্ষীণ স্বরে বলল, মরতে মন চায় না।
দীর্ঘ সময় বদরুল আলম সাহেব ইউনুসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার একটা পা ফুলে কোল বালিশের মত হয়ে গেছে। এই পায়েই বোধ হয় শিয়াল কামড়েছে।
ইউনুস বলল, আপনে যদি বলেন তাইলে আরেকবার ঠিকমত তওবা করি।
থাক, তার আর দরকার নাই। তোর যখন অতই বাঁচনের শখ, দেখি একটা চেষ্টা কইরা। চল, তোরে ময়মনসিং নিয়া যাই। দেখি কি অবস্থা।
ইউনুস মনে হয় কথাগুলি ঠিক বুঝতে পারে না। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে।
বদরুল আলম সাহেব রাতেই মহিষের গাড়ির ব্যবস্থা করেন। প্রথমে যেতে হবে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে ময়মনসিংহ। সেখানে ডাক্তাররা জবাব দিলে নিতে হবে ঢাকা।
মহিষের গাড়ি রওনা হল রাত আটটায়। অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে অবাক করে দিয়ে তিনিও সংগে চললেন। অনেক দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটির ব্যাপার আছে। ছেলে ছোকরাদের উপর ভরসা করা যায় না।
ইউনুস?
জ্বে।
ঝুলে থাক। হাল ছাড়িস না, আমি আছি।
ইউনুসের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সে প্রাণপণে ঝুলে থাকতে চেষ্টা করে। মহিষের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে যায়।
কৃষ্ণপক্ষ
হানিফ দাঁড়িয়ে আছে জারুল গাছের নীচে।
জায়গাটা বেশ সুবিধাজনক, গাছ গাছড়ায় ঝুপড়ির মত হয়ে আছে–দূর থেকে তাকে দেখার উপায় নেই। টর্চের আলো ফেললেও বোঝা যাবে না। কিছু কিছু বেআক্কেল লোক টর্চের আলো রাস্তায় ফেলার বদলে আশে পাশের ঝোপ ঝাড়েও ফেলে। তবে আশার কথা হল টর্চওয়ালা লোক এই অঞ্চলে নেই বললেই হয়। যে দু’একজন আছে তারা ব্যাটারি বাচাবার জন্যে খুট করে খানিকটা আলো ফেলেই টর্চ নিভিয়ে ফেলে।
ভাদ্র মাস।
তালপাকা গরম পড়েছে। হানিফের গায়ে মার্কিন কাপড়ের মোটা পাঞ্জাবী। গা অসম্ভব ঘামছে। অবশ্যি এই রকম অবস্থায় সব সময় তার গা ঘামে। মাঘ মাস হলেও ঘামতো। বড় ধরনের কোন কাজের আগে আগে তাঁর এমন হয়। মানুষ মারা সহজ কোন কাজ না। বড় কাজ।
হানিফ দাঁড়িয়ে আছে নওয়াবগঞ্জের মুনশি রইসুদ্দীন নামের একজন লোককে খুন করার জন্যে। মুনশি রইসুদ্দিনকে সে চেনে না। লোকটা ভাল কি মন্দ তাও জানে না। তবে মন্দ হবারই সম্ভাবনা। ভাল নির্বিরোধী কোন মানুষকে কেউ খুন করতে চায় না।
অবশ্যি লোকটি ভাল হলেও কিছু যায় আসে না। কাজটা করে দিলে হানিফ পাঁচ হাজার টাকা পাবে এটাই আসল কথা। পাঁচ হাজারের মধ্যে এক হাজার তাকে দেয়া হয়েছে। বাকি চার হাজার কাজ শেষ হলে পাওয়া যাবে। আজ কাজ শেষ হলে আজ রাতেই। এইসব ব্যাপারে টাকা পয়সা নিয়ে কেউ ঝামেলা করে না। মাঝে মাঝে বেশীও পাওয়া যায়।
তিন বছর আগে এই রকম একটা কাজের জন্যে দুই হাজার টাকা বেশী পাওয়া গেল। ছ’হাজারের চুক্তি হয়েছিল। পুরো টাকাটা পাওয়ার পর হানিফ বলল, বখশীস দেবেন না? মোবারক শাহ নামের আধবুড়ো মানুষটা অতি দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, অবশ্যই দিব। অবশ্যই দিব। তৎক্ষনাৎ দু’হাজার টাকা দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, আপনে খুশী তো?
এই একটা মজার ব্যাপার, কাজ শেষ হবার পর তাকে আপনি আপনি করে বলা হয়। এর আগে তুমি। হানিফের ধারণা ভয়ের চোটে আপনি বলে।
হানিফ মোবারক শাহ নামের বুড়ো লোকটাকে বলেছিলো—আমি বসতেছি। কাজ ঠিকমত সমাধা হয়েছে কি-না খোঁজ নিয়ে আসেন, তারপর যাব।
মোবারক শাহ চমকে উঠে বলেছিল—তার দরকার হবে না। আপনের কথা যোল আনা বিশ্বাস করতেছি। আপনার বসতে হবে না, আপনি যান।
একটু বসি। এক কাপ চা খাই।
মোবারক শাহ ফ্যাকাশে মুখে বলেছে, চায়ের আয়োজন বাড়িতে নাই। আপনে দোকানে গিয়া চা খান। ভংতি টাকা দিতাছি। এই বলে পাঁচ টাকার ময়লা একটা নোট বের করে দিল। হানিফ নোটটা পকেটে রাখতে রাখতে মনে মনে হেসেছে। লোকটার ভয় দেখতে মজা লাগছে, হারামজাদা, মানুষ মারবার সময় খেয়াল ছিল না?
আপনে তা হইলে এখন যান। বেশীক্ষণ থাকা ঠিক না।
হানিফ উদাস গলায় বলল, কোন অসুবিধা নাই।
আপনে হইলেন বিদেশী লোক, আপনেরে সন্দেহ করবো।
আরে না, কী সন্দেহ করবো? এত বড় গঞ্জ, বিদেশী লোক তো থাকবই। এক গ্লাস পানি দিতে বলেন।
পানি দিতেছি। পানি খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান।
পানি খাওয়ার পরও হানিফ যায় না। জর্দা দিয়ে পান খেতে চায়। পান মুখে দিয়ে বিড়ি ধরায়। উদাস ভঙ্গিতে টানতে থাকে।
আসলে কাজ শেষ হবার পরপরই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে তার ইচ্ছা করে না। বড়ই ক্লান্ত লাগে। ঘুম পায়। তাছাড়া এইসব ঘটনার পর কি সব কথাবার্তা রটে সেইগুলিও শুনতে ইচ্ছা করে। থানা থেকে পুলিশ সাহেব এসে চারদিকে মিথ্যা আতংক জাগিয়ে তোলে। একে ধমকায়, তাকে ধমকায় — এইগুলি দেখতে ভাল লাগে। পুলিশ সাহেব মুখে দুঃখ এবং রাগ রাগ ভাব ফুটাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। পুলিশ সাহেবের মুখ দেখেই মনে হয় তিনি গভীর আনন্দবে করছেন। খুন খারাবি মানেই তাঁদের পকেটে কিছু কাঁচা পয়সা। কাজেই এইসব ঘটনায় তাঁরা আনন্দিতই হবেন। এটাই স্বাভাবিক। খুব কম করে হলেও দশ বারজনকে ধরে হাজতে পুরে দিবেন। ওদের ছাড়াতে টাকা লাগবে। খুনীর শত্রুদের টাকা দিতে হবে। যে খুন হয়েছে তার আত্মীয় স্বজনদেরও টাকা খরচ করতে হবে। টাকারই খেলা।