স্যার, আমি কিছুই বলবার চেষ্টা করছি না। এখন যা বলার তা আপনি বলবেন। আমি শুধু শুনব।
এর মানে কি?
কোনো মানে নেই, স্যার। আপনি এত মানে খুঁজছেন কেন?
দু জন আবার হাঁটতে শুরু করল। কালীমন্দিরের সামনে মেজর সাহেব থামলেন। কালীমূর্তি তিনি এর আগে দেখেন নি। একটিমাত্র দরজা খোলা, পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেজর সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখতে চাইলেন। রফিক বলল, স্যার, ঝড় হবার সম্ভাবনা। আমাদের তাড়াতাড়ি ফেরা উচিত।
ফিরব, তোমাদের কালীমূর্তি দেখে যাই।
তোমাদের বলা ঠিক নয়, স্যার। আমি মুসলমান।
তোমরা মাত্র পঁচিশ ভাগ মুসলমান, বাকি পঁচাত্তর ভাগ হিন্দু। তুমি মন্দিরে ঢুকে মূর্তিকে প্রণাম করলেও আমি কিছুমাত্র অবাক হব না।
রফিক কোনো জবাব দিল না। মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় ধরে আগ্রহ নিয়ে মূর্তি দেখলেন। হাসিমুখে বললেন, চারটি হাতে এই মহিলাটিকে মাকড়সার মতো লাগছে। লাগছে না?
আমার কাছে লাগছে না। আমরা ছোটবেলা থেকেই মূর্তিগুলি এ-রকম দেখে আসছি। আমার কাছে এটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়।
মেজর সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন, তারপর অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রফিক।
জ্বি স্যার?
এই মুর্তিটির পেছনে এক জন কেউ লুকিয়ে আছে।
রফিক চুপ করে রইল।
তুমি সেটা আমার আগেই বুঝতে পেরেছ। পার নি?
রফিক জবাব দিল না।
বুঝতে পেরেও আমাকে কিছু বল নি।
রফিক ক্লান্ত স্বরে ডাকল, বলাই বলাই। মূর্তির পেছনে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠল।
তুমি কী করে বুঝলে ও বলাই?
আমি অনুমান করছি। মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে, তাই অনুমান করছি। বলাই নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কেউ। হয়তো কানাই।
মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে সে কি ভাবছে মা কালী ওকে রক্ষা করবেন?
ভাবাই তো স্বাভাবিক। অনেক মুসলমান এ-রকম অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয়। ভাবে আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করবেন।
মেজর সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। রফিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, অনেক জায়গায় মসজিদ থেকে টেনে বের করে ওদের মারা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করতে পারেন নি।
তুমি কী বলতে চাচ্ছ?
আপনি যদি বলাইকে মারতে চান–কালীমূর্তি ওকে রক্ষা করতে পারবে না। এটাই বলতে চাচ্ছি, এর বেশি কিছু না।
ওকে বের হয়ে আসতে বল।
রফিক ডাকল, বলাই, বলাই। বলাই জবাব দিল না।
একটা মৃদু ফোঁপানির শব্দ শোনা গেল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঝড় শুরু হল। প্রচণ্ড ঝড়। মেজর সাহেব মন্দিরের ভেতর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হুম-হুম শব্দ উঠছে। দেখতে-দেখতে আবহাওয়া রুদ্র মূর্তি ধারণ করল। মন্দিরসংলগ্ন বাঁশঝাড়ে ভয়-ধরানো শব্দ হতে লাগল। রফিক এসে দাঁড়াল মেজর সাহেবের পাশে। মেজর সাহেব মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, বিউটিফুল! কালীমূর্তির পেছনে উবু হয়ে বসে থাকা বলাইয়ের কথা তাঁর মনে রইল না। ঝড়ের সঙ্গে-সঙ্গে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মেজর সাহেব দ্বিতীয় বার বললেন, বিউটিফুল!
সামনে খোলা মাঠ। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মাঠে ধূলি ও শুকনো পাতায় ঘূর্ণির মতো উঠেছে। এর মধ্যেই খালিগায়ে একজনকে ছুটে যেতে দেখা গেল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে মহা উল্লসিত। মেজর সাহেব বললেন, লোকটিকে দেখতে পাচ্ছ? রফিক নিস্পৃহ স্বরে বললো, ও নিজাম, পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটি পাগল থাকে।
এ-গ্রামের সবাইকে কি তুমি এর মধ্যেই চিনে ফেলেছ?
না, কয়েক জনকে চিনি। সবাইকে না।
ঐ পাগলটা কি জঙ্গলা-মাঠের দিকে যাচ্ছে না?
মনে হয় যাচ্ছে। পাগলরা বন-জঙ্গল খুব পছন্দ করে। মানুষের চেয়ে গাছকে তারা বড় বন্ধু মনে করে।
রফিক।
জ্বি স্যার।
তোমার পড়াশোনা কদ্দূর
পাস কোর্সে বি. এ. পাশ করেছি।
মাঝে-মাঝে তুমি ফিলসফারদের মতো কথা বল।
পরিবেশের জন্যে এ-রকম মনে হয়। বিশেষ বিশেষ পরিবেশে সাধারণ কথাও খুব অসাধারণ মনে হয়।
তা ঠিক।
মেজর সাহেব মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন! ঝড়ের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। মন্দিরের একটা জানালা খুলে গিয়েছে। খটখট শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। রফিক বলল, স্যার কি ভেতরে গিয়ে বসবেন?
না।
পাগল নিজাম সত্যি-সত্যি কি বনের ভেতর ঢুকেছে? মেজর সাহেব তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁকে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। কপালে ভাঁজ পড়েছে।
রফিক।
জ্বি স্যার।
জর্জ বার্নার্ড শ মিলিটারি অফিসার সম্পর্কে কী বলেছেন জান?
জানি না স্যার।
তিনি বলেছেন, দশ জন মিলিটারি অফিসারের মধ্যে ন জনই হয় বোকা। বাকি এক জন রামবোকা।
জর্জ বার্নার্ড শর রচনা আমাদের সিলেবাসে ছিল না। আমি তাঁর কোনো লেখা পড়ি নি।
লোকটি রসিক। তবে তাঁর কথা ঠিক নয়। মাঝে-মাঝে মিলিটারি অফিসারদের মধ্যেও বুদ্ধিমান লোক থাকে। যেমন আমি। ঠিক না?
জ্বি স্যার।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি যাকে পাগল বলছ, সে পাগল নয়। সে জঙ্গলা মাঠে যাচ্ছে খবর দিতে।
নিজাম আলি পাগল। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
কী কথা হয়েছে?
পাগলদের সঙ্গে যে-রকম কথা হয় সে-রকম। বিশেষ কিছু না।
বুঝলে কী করে, ও পাগল?
ও মিলিটারি আসায় অত্যন্ত খুশি হয়েছে। এর থেকেই বুঝেছি।
তুমি বলতে চাও মিলিটারি আসাটা কোনো আনন্দের ব্যাপার নয়?
জ্বি-না স্যার।
মেজর সাহেব ভূ কুঞ্চিত করে দূরের বনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চল যাই।
কোথায়?