রফিক তার জবাব দিল না! হাঁটতে শুরু করল। ইমাম সাহেব তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেন না। ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছেন। তার জন্যে দুজনকেই মাঝে-মাঝে দাঁড়াতে হচ্ছে। রফিক বলল, হাঁটতে কষ্ট হলে আমার হাত ধরে হাঁটেন।
জ্বি-না। কোনো কষ্ট নাই।
লজ্জার কিছু নাই। আমার হাত ধরে হাঁটেন।
শুকরিয়া। ভাই, আপনার বয়স কত?
আমার বয়স দিয়ে কী করবেন?
এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
আপনাকে তো বলেছি বিনা প্রয়োজনে কথা বলবেন না।
জ্বি, আচ্ছা।
আমার বয়স তিরিশ।
রফিককে দেখে বয়স আরো বেশি মনে হয়। রোগা এবং লম্বা। ছোট ছোট চোখ। কথা বললে চোখ আরো ছোট হয়ে যায়। মনে হয় লোকটি যেন চোখ বন্ধ করে কথা বলছে।
ইমাম সাহেব দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জুয়ালেমিন।
মনা কৈবর্ত তার এগার বছরের ভাইকে নিয়ে তেতুল গাছের নিচে চুপচাপ বসে আছে। মনার শরীর বিশাল প্রায় দৈত্যের মতো। তার ভাইটি অসম্ভব রোগা। সে মনার লুঙ্গির এক প্রান্ত শক্ত করে ধরে আছে। তাকাচ্ছে সবার মুখের দিকে। বারবার কেঁপে-কেঁপে উঠছে। মনাকে খুব একটা বিচলিত মনে হচ্ছে না।
মেজর সাহেব প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তাঁর সঙ্গে এক জন নন-কমিশন্ড অফিসার। এরা দু জন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। মেজর সাহেব সম্ভবত কোনো রসিকতা করলেন। দু জনেই উঁচু গলায় হাসতে শুরু করল। মনার ভাইটি চোখ বড়-বড় করে তাকাল তাদের দিকে। বিলের পারের উঁচু জায়গায় এক দল রাজাকার দাঁড়িয়ে। খুব কাছেই মিলিটারি আছে বলেই হয়তো তার বুক ফুলিয়ে আছে। অহঙ্কারী গর্বিত ভঙ্গি। এদের মধ্যে শুধু দু জনের পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল। বাকি কারোর পায়ে কিছু নেই। এরা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে কথা বলছে। তবে এদের মুখ শুকনো, ভয় পাওয়া চোখ।
মেজর সাহেব এগিয়ে এলেন মনার দিকে। মনার ছোট ভাইটি শক্ত হয়ে গেল। মনার সঙ্গে মেজর সাহেবের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল। কথাবার্তা হল রফিকের মাধ্যমে। আজিজ মাস্টার ও ইমাম সাহেবকে সরিয়ে দেওয়া হল। তারা বসে রইল বিলের পাড়ে। প্রশ্নোত্তর শুরু হল।
তুমি একটি খুন করেছ?
মনা জবাব দিল না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
চুপ করে থাকবে না। স্পষ্ট জবাব দাও বল হ্যাঁ কিংবা না।
হ্যাঁ।
গুড। স্পষ্ট জবাব আমি পছন্দ করি। এখন বল—কেন করেছ? বিনা কারণে তো কেউ মানুষ মারে না।
হে আমার পরিবারের সঙ্গে খারাপ কাম করছে।
তাই নাকি?
জ্বে আজ্ঞে।
উত্তেজিত হবার মতোই একটি ব্যাপার। তোমার স্ত্রীকে কি শাস্তি দিয়েছ?
মনা মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। প্রশ্নের ধারা সে বুঝতে পারছে না।
বল, বল। কুইক। সময় বেশি নেই আমার হাতে।
মনা ঘামতে শুরু করেছে।
আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো শাস্তি দাও নি।
জ্বি-না।
সে নিশ্চয়ই খুব রূপবতী?
মনা চোখ তুলে তাকাল। কিছুই বলল না।
বল। চট করে বল। সে কি রূপবতী?
জ্বি।
তাহলে অবশ্যি শাস্তি না-দিয়ে ভালোই করেছ। একটি সুন্দরী নামের শাস্তি দেয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তোমার স্ত্রীর নাম কি?
মনার চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল। মেজর সাহেবের কথাবার্তা কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
বল, তোমার স্ত্রীর নাম বল।
মন কিছুই বলল না। রফিক বলল, গ্রামের মানুষরা অপরিচিত মানুষের কাছে স্ত্রীর নাম বলে না।
কেন বলে না?
আমি জানি না স্যার।
তুমি তো অনেক কিছুই জান, এটা জান না?
আমি অনেক জিনিস জানি না।
মেজর সাহেব মনার দিকে আরো কয়েক পা এগোলেন। আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, এই ছেলেটি কী হয় তোমার?
এ আমার ছোট ভাই।
ওর নাম কি?
বিরু।
মেজর সাহেব তাকালেন বির দিকে। বিরু কুঁকড়ে গেল। মেজর সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, বির, তুমি লুঙ্গি ধরে টানাটানি করছ কেন? লুঙ্গি ছেড়ে দাও। বিরু লুঙ্গি ছেড়ে দিল না। আরো ঘেঁষে গেল ভাইয়ের দিকে। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া পড়েছে। শিশুরা অনেক কিছু আগেই বুঝতে পারে। সেও হয়তো পারছে।
মনা।
জ্বি।
তুমি বড় একটা অন্যায় করেছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শাস্তি হবে। তোমার কী বলার আছে?
মনা তাকিয়ে রইল। তার চোখে পলক পড়ছে না। মেজর সাহেব সিগারেট ধরালেন। অস্থির ভঙ্গিতে দৃঢ় স্বরে বললেন, এই দুজনকে পানিতে দাঁড় করিয়ে দাও। রফিক ইংরেজিতে বলল, এই বাচ্চাটিকেও?
হ্যাঁ। স্যার, এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?
প্রয়োজন আছে। এর প্রয়োজন আছে। আমি নিষ্ঠুরতার একটা নমুনা দেখাতে চাই।
স্যার, তার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন আছে। আজ এই ঘটনাটি পর মিলিটারির নামে শুনলে ব্রা কাপড় নষ্ট করে দেবে। গর্ভবতী মেয়েদের গর্ভপাত হয়ে যাবে।
তাতে কী লাভ স্যার?
লাভ-লোকসান আমার দেখার কথা, তোমার না। আমার সঙ্গে তর্ক করবে না।
রফিক চুপ করে গেল। মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, এ-সব কথা পরবর্তী সময়ে কেউ মনে রাখবে না। অত্যাচারী রাজারা ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মানিত হন। আলেকজান্ডারের নৃশংসতার কথা কি কেউ জানে? সবাই জানে–আলেকজান্ডার দি গ্রেট।
রফিক কিছুই বলল না। মেজর সাহেব সহজ সুরে বললেন, যা করতে বলা হয়েছে। কর। আর শোন, ঐ ইমাম এবং ঐ মাস্টার – ওদের দুজনকে খুব কাছাকাছি কোথাও বসিয়ে দাও। আমি চাই যাতে ব্রা খুব ভালোভাবে দৃশ্যটা দেখে।