জি না স্যার।
দাওনি কেন?
বাবা কারোর সেবা নিতে পছন্দ করেন না।
কেন করেন না?
জানি না স্যার।
তিনি কি তোমার সঙ্গে থাকেন?
তিনি একটা হোটেলে রুম নিয়ে থাকেন।
তার জন্যে তাকে মাসে কত ভাড়া দিতে হয়?
তাকে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। হোটেলের মালিক তার ছাত্র। আমার বাবা স্কুল-মাস্টার ছিলেন। ভাড়া দিয়ে হোটেলে বাস করার সামর্থ্য তাঁর নেই।
মবিনুর রহমান তার দৃষ্টি আবারো টিভির দিকে ফিরালেন। আবারো তিনি দুলতে শুরু করেছেন। হঠাৎ দুলুনি বন্ধ করে শফিকের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তোমার বাবা কারেরি সেবা যে নেন না তার কারণ মনে হয় আমি বের করতে পেরেছি। তিনি সেবা নেন না কারণ সেবা নিলে তার মূল্য দিতে হয়। ওনার মূল্য দেবার সামর্থ্য নেই। আমার যেহেতু সামর্থ্য আছে, আমি সেবা নেই এবং সেবা নিতে আমার খারাপ লাগে না। আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে তোমার কেন খারাপ লাগছে আমি বুঝতে পারছি না। তুমি কি আমার চাকরিটা করতে চাচ্ছ না?
চাচ্ছি স্যার! আমি খুবই খারাপ অবস্থায় আছি।
যাও বাথরুম থেকে ক্রিম নিয়ে এসো।
মবিনুর রহমান চোখ বন্ধ করে আছেন। শফিক তার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। মবিনুর রহমান তাঁর বাঁ পা এগিয়ে দিয়েছেন। শফিক পায়ে ক্রিম ঘষছে। ক্রিমের গন্ধ তীব্র। শফিকের মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর গুলাচ্ছে।
শফিক।
জি স্যার।
লায়লাকে মনে আছে?
মনে আছে ওনার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে আপনার বিয়ে হয়েছিল।
তোমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা হোক—কখন বিয়ে হয়েছিল। কখন ভাঙলো?
রতি একটা দশে বিয়ে হয়েছিল, ভোর আটটা দশে বিয়ে ভেঙেছে।
তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো। এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে। কি কাজ শুনতে চাও।
স্যরি বলুন।
তোমার একমাত্র কাজ লায়লার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তার আস্থাভাজন হওয়া। আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি তুমি জানো না?
জানি। আপনি বলেছেন।
আমার নিকটজন বলতে একজনই— লায়লী। তার প্রতি যদি প্রবল দুর্বলতা বোধ করি সেটা নিশ্চয়ই দোষের না। এমনও তো হতে পারে দেখা গেল আমার মৃত্যুর পর আমি সব কিছুই তাকে দিয়ে গিয়েছি। হতে পারে না?
জি স্যার।
কাজেই লায়লা ভরসা করতে পারে এমন কিছু লোকজনের সঙ্গে আগে থেকেই তার পরিচয় থাকা উচিত। তুমি তাদের একজন। তুমি কখনোই মনে করবে না যে আমি হুট করে তোমাকে নিয়েছি। অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই তোমাকে নেয়া হয়েছে।
মবিনুর রহমান এখন চোখ মেলেছেন। তাকিয়ে আছেন শফিকের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিতে আগের তীক্ষ্ণ ভাবটা নেই। তিনি হালকা গলায় বললেন, আমি ক্যাশিয়ার সোবাহানকে বলে দিচ্ছি তোমাকে যেন একটা সার্বক্ষণিক গাড়ি দেয়া হয়। হুট হাট করে তোমাকে নারায়ণগঞ্জ যেতে হতে পারে।
সোবাহান সাহেব খুবই অবাক হয়ে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন তিনি শফিককে চেনেন না। শফিক অচেনা কেউ। শফিক বলল, কিছু বলবেন? সোবাহান সাহেব নিচু গলায় বললেন, বড় সাহেব আপনার জন্যে একটা ফুল টাইম গাড়ি সংশন করেছেন।
ও আচ্ছা।
আপনি জিপ গাড়িটা নিন। গাড়ি পুরনো হলেও ভালো। ড্রাইভারের নাম রঞ্জু। লোক ভালো। গাড়িতে লগ বুক আছে। কোথায় যান না যান একটু লিখে রাখবেন। তেলের হিসাবের জন্যে, অন্য কিছু না। গাড়ি আপনার বাসায় রাতে থাকবে।
শফিক বলল, আমি দরিদ্র মানুষ। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই।
গ্যারেজ লাগবে না। বাসার সামনে গাড়ি রেখে রঞ্জু গাড়িতে ঘুমাবে। স্যার ফুল টাইম গাড়ি দিতে বলেছেন। গাড়ি ফুল টাইম থাকবে। এইসব বিষয়ে স্যারের নিয়ম-কানুন কঠিন। এক কাপ চা আমার সঙ্গে খাবেন?
না।
আপনার ভাগ্য খুবই ভালো, স্যার আপনাকে পছন্দ করেছেন।
ফুল টাইম গাড়ি দিয়েছেন এই জন্যে বলছেন?
জি না এই জন্যে না। আপনার বেতনও বাড়ানো হয়েছে। পনেরো হাজার করা হয়েছে। আগারগাঁওয়ে আমাদের যে স্টাফ কোয়ার্টার, সেখানে আপনাকে ফ্ল্যাট দিতে বলেছেন।
সোবাহান সাহেব শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ চকচক করছে।
শফিক বাসায় ফিরল রাত আটটার দিকে। রিকশায় আসতে হয়নি গাড়ি নিয়ে এসেছে। আজো সে খালি হাতে আসেনি। আধাকেজি রসমালাই নিয়ে এসেছে।
মীরা আনন্দিত গলায় বলল, আজ দেখি সকাল সকাল চলে এসেছ?
শফিক বলল, সকাল সকাল এসে কোনো সমস্যা তো তৈরি করি নি। না-কি কোন সমস্যা তৈরি করেছি?
মীরা বলল, এ রকম রাগী রাগী গলায় কথা বলছ কেন? আমি কথার কথা বলেছি, রাত আটটা এমন কোন সকালও না। যারা অফিস করে দশটা-পাঁচটা করে। তোমার মতো ভোের সাতটায় গিয়ে রাত দশটায় ফেরে না।
এত কথা বলছ কেন? হড়বড় হড়বড় করেই যাচ্ছ। নিশো কোথায়?
তার ছোট মামা এসে নিয়ে গেছে।
কেন?
জলিলের বড় মেয়ের জন্মদিন। জন্মদিনে গেছে।
রাতে ফিরবে না?
না।
তুমি খুব ভালো করে জানো নিশো রাতে বাইরে থাকবে এটা আমার খুবই অপছন্দ।
নিশো খুব যেতে চাচ্ছিল।
মীরা চুপ করে রইল। মানুষটা হঠাৎ কেন এত রাগ করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। মীরা বলল, তুমি কি এখন খাবে না দেরি হবে? দেরি হলে চা করে দেই।
আমি রাতে কিছু খাব না।
কেন?
ক্ষিদে নেই।
কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ রান্না করেছিলাম।
হাতির বিচি দিয়ে পুঁটকি মাছ রান্না করলেও খাব না।
এইসব কী ধরনের কথা?
শুনে অপমান লাগছে? আমার সঙ্গে বাস করলে এই ধরনের অপমানসূচক কথা শুনতে হবে। শুনতে যদি ভাল না লাগে এমন জায়গায় চলে যাও যেখানে এ ধরনের কথা শুনবে না।