জি স্যার পারব।
ক্যাশিয়ার সোবাহানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুই ঝুড়ি আম কিনবে। গোপালভোগ আর হিমসাগর। দেখে-শুনে কিনতে পারবে না?
পারব।
বাজারে আম কি উঠেছে?
জি উঠেছে।
দিনাজপুরের লিচু কি পাওয়া যায়?
পাওয়া যায়।
শদুই লিচুও নিয়ে যাবে।
স্যার আজ যাব?
আজ যাবার দরকার নাই। কোনো এক ছুটির দিনে যাবে। লায়লা শুনেছি কোন এক স্কুলে মাস্টারি করে। এমন দিনে যাওয়া উচিত যেন সে বাসায় থাকে। বুঝেছ? অন্য কারো হাতে পাঠালে বুঝতেও পারবে না কে পাঠিয়েছে, কি সমাচার। তাই না?
জি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও। আজ তোমার ডাল রান্না করার কথা। ভুলে যেও না। কীভাবে রাঁধতে হয় শিখিয়ে দিয়েছিলাম। মনে আছে না?
মনে আছে।
আমি রান্নাবান্না সব এতিমখানার বাবুর্চির কাছে শিখেছি। বাবুর্চির নাম সিদ্দিক। সিদ্দিক ভাই ব্লাঁধতেন, আমি পাশে বসে থাকতাম। রান্নার সময় নানা গল্প-গুজব করতেন। ছড়া বলতেন। সবই রান্না বিষয়ক। একটা ছড়া তোমাকে বলি শোনো। চিংড়ি মাছ বিষয়ক–
ইচা
কাটতে মিছা
ধুইতে নাই
খাইতে গেলে আবার পাই।
ঘটনা বুঝতে পারছ?
জি না স্যার।
ইচা হলো চিংড়ি মাছ। কটিতে মিছা মানে কাটা অনর্থক। ধুইতে নাই মানে ধোবার সময় মাছ খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আবার খেতে গেলে পাওয়া যাবে। বুঝেছ?
জি স্যার।
এখন নিচে গিয়ে খোঁজ নাও আমজাদ এই পর্যন্ত মোট কত বার উঠবোস করেছে।
শফিক দোতলা থেকে একতলায় নেমে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ভালো লাগছে। স্বস্তিবোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বড় সাহেবের সামনে এতক্ষণ সে ত্রিশ কেজি বোঝা মাথায় নিয়ে চেয়ারে বসেছিল সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে বোঝাটা চেয়ারে নামিয়ে এসেছে। আবার যখন তিনি ডেকে পাঠাবেন, বোঝা মাথায় নিয়ে তার আশপাশে ঘুরঘুর করতে হবে। কোনো মানে হয়?
শফিক একতলায় নেমে প্রথম যে কাজটি করল তা হলো সিগারেট ধরালো। প্রথম সিগারেট অতি দ্রুত শেষ করে চায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় সিগারেট। একতলায় কর্মচারীদের যে রান্নাঘর আছে, সেখানে চুলায় চায়ের পানি সব সময় ফুটছে। টি ব্যাগ-চিনি-দুধ সবই রাখা আছে। চা বানানোর আলাদা লোক নেই, নিজের হাতে বানাতে হবে।
শফিক চায়ের কাপ নিয়ে একতলার পেছনের বারান্দায় চলে এলো। মেজাজ খুব খারাপ লাগছে। বড় সাহের তাকে কাজ দেবেন বলেছেন। কাজটা কি এখনো জানা যায়নি। মনে হয় তার পরীক্ষা শেষ হয়নি।
শফিক সাহেব চা খাচ্ছেন নাকি?
শফিক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ক্যাশিয়ার সাহেব তার দিকে আসছে। তার কি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানো উচিত? পদাধিকারে ক্যাশিয়ার তার চেয়ে বড় না ছোট? কোনো কিছুই সে জানে না। সে এমন এক চাকরি করছে যে চাকরিতে তার পজিশন কি সে কিছুই জানে না। শফিক উঠে দাঁড়াল না তবে উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করল।
সোবাহান সাহেব যন্ত্রের মতো বললেন, আপনার জন্যে একটা মোবাইল টেলিফোন স্যাংশান হয়েছে। সাইন করে নিয়ে যাবেন। কোনো কারণে চাকরি টার্মিনেট হলে কিংবা আপনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলে সেইটা অফিসে দিয়ে যাবেন।
শফিক হাসি মুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেও মনে মনে বলল, তোর ঐ সেট তুই…দিয়ে বসে থাক। অতি কুৎসিত এই বাক্য তার মাথায় আসছে কেন সে বুঝতে পারছে না। সোবাহান সাহেব মানুষটার চেহারা ভদ্র। কথাবার্তা ভালো। তাকে দেখে মাখায় গালাগালি আসার কথা না।
শফিক সাহেব চাকরি কেমন লাগছে?
বুঝতে পারছি না কেমন লাগছে।
প্রথম কয়েক দিন মন বসবে না, তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
শফিক বলল, প্রথম কতদিন মন বসবে না?
সোবাহান সাহেব বললেন, এটা একটা কথার কথা বললাম। স্যারের এখানে কাজকর্ম কিছুই নাই এইটাই সমস্যা। স্যার যেমন কিছু করেন না, দিনরাত শুয়ে বসে থাকেন, আমাদেরও তাই করতে হয়। মানুষ তো কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। ঠিক বলেছি না?
ঠিক বলেছেন।
গরুকে যেমন সারাদিন ঘাস খেতে হয়, মানুষকেও সে রকম সারাদিনই কিছু কিছু করতে হয়। আমাদের এখানে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। আপনার ইচ্ছা হলে খেলতে আসবেন।
কী খেলা?
সোবাহান সাহেব শফিকের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ক্যারাম আছে, দাবা আছে। রাতে নাইন কার্ড খেলা হয়। নাইন কার্ড জানেন?
না।
ভেরি ইজি। অল্প স্টেকে খেলা হয়। দশ মিনিট খেলা দেখলে শিখে ফেলবেন। তবে আপনি তো রাতে থাকেন না। রাতে থাকলে মজা পেতেন।
শফিক বলল, চা খাবেন? আপনার জন্যে চা নিয়ে আসব? আমি আরেক কাপ খাব এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি।
না চা খাব না। আপনার মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই।
শফিক চা এনে আবার নিজের জায়গায় বসল। তার ক্ষীণ আশা ছিল ফিরে এসে দেখবে সোবাহান সাহেব চলে গেলেন। অকারণ কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছে না। এই লোকের অভ্যাস মনে হয় অকারণ কথা বলা।
সোবাহান সাহেব ঝুঁকে এসে বললেন, আপনি কি দুধ চা খান?
জি।
দুধ চায়ের চেয়ে রঙ চা ভাল। কনডেন্স মিল্কের চা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। কনডেন্স মিল্কের প্রধান ইনগ্রেডিয়েন্ট পামওয়েল। শরীরের জন্যে বিষ বলতে পারেন।
শফিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমার কাজটা ঠিক কী বলতে পারেন?
সোবাহান সাহেব বললেন, আসবেন যাবেন চা খাবেন এই তো কাজ। এর বেশি কিছু না। স্যার অবসর নিয়েছেন। স্যারের সঙ্গে আমরা সবাই অবসরে।
কর্তা যান বঙ্গে আমরা যাই সঙ্গে।
উনি কোথাও বের হন না?
সপ্তাহে একদিন ওনার পীর সাহেবের কাছে যান। বুধবার রাতে।