জানি না কেন। আচ্ছা মা শোনো, আজ আমার কোথাও বেড়াতে যেতে করছে।
কোথায়?
বিশেষ কোথাও না–এই ধরো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাম। নিউমার্কেটের দোকানগুলো দেখলাম।
যাই করিস তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে করব।
সমস্যা তো এইখানেই।
রুমু রান্নাঘরে ঢুকল। তার হাতে একটা সে লিলির হাতে দিয়ে যেভাবে চুপিচুপি এসেছিল সেভাবেই বের হয়ে গেল। ফরিদা বললেন, কার চিঠি?
স্বাতীর চিঠি।
যাক, বাঁচা গেল। আমি ভাবলাম রুমু ঝুমুর মাস্টার বুঝি প্রেমপত্র লিখে ফলেছে। ওর তাকানো ভালো না। শকুনের মতো কেমন করে যেন তাকায়। স্বাতী ঠাৎ চিঠি লিখল কেন?
আজ ওর জন্মদিন। যেতে বলেছে। মা, যাব?
তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
বাবা যেতে দেবে না।
দিতেও পারে। তোকে পছন্দ করে। নরম গলায়, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে দেখ।
এখন বলব?
না, এখন না। খবরের কাগজটা আসুক। খবরের কাগজ হাতে পড়লে মেজাজ একটু ভালো থাকে। তখন এক কাপ চা নিয়ে যাবি তারপর বলবি।
নেয়ামত সাহেব খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সামনে এসট্রে আছে। ছাই এসট্রেতে ফেলছেন না, চারপাশে ফেলছেন। লিলি চায়ের কাপ তাঁর সামনে রাখতে রাখতে বলল, বাবা আমার এক বান্ধবী যে আছে স্বাতী, আজ ওর জন্মদিন।
নেয়ামত সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। লিলি বলল, আমাকে খুব করে যেতে লিখেছে। এক ঘণ্টার জন্য।
তোর বান্ধবীর জন্মদিন?
জি।
বুড়ো ধাড়ি মেয়ের আবার জন্মদিন কি? এসব আমার পছন্দ না। ছুটির দিন বাসায় থাকবি। বাইরে বাইরে ঘুরবি কেন? যা, মাকে সাহায্য কর। একা মানুষ চারদিক সামলাচ্ছে, তাকে দেখে একটু মায়াও হয় না।
নেয়ামত সাহেব আবার কাগজ পড়তে শুরু করলেন। লিলি চায়ের কাপ নামিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
স্বাতী ভেবে রেখেছিল
স্বাতী ভেবে রেখেছিল সে তার জন্মদিনে লিলিকে ব্যাপারটা বলবে। ভয়ঙ্কর অন্যায় যে সে করেছে সেই ব্যাপারটা। লিলি আতঙ্কে শাদা হয়ে যাবে। পরপর কয়েক বার বলবে, এখন কী হবে রে? এখন কী হবে? তখন স্বাতী তার পরিকল্পনার কথা বলবে। সেটা শুনে লিলি আরও আতঙ্কগ্রস্ত হবে।
নিজের আতঙ্ক অন্যের ভেতর দেখলে নিজের আতঙ্ক খানিকটা কমে। স্বাতী খানিকটা স্বস্তি পাবে। এবং কিছুটা সাহসও পাবে। সেই সাহসটা পাবার পর স্বাতী ব্যাপারটা তার মাকে বলতে পারবে। মাকে কিভাবে বলবে তা সে ঠিক করে রেখেছে। ভয়ঙ্কর অন্যায়ের ব্যাপারটা মাকে বলা হবে সবার শেষে। চেষ্টা করবে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা না বলতে। তবে তিনি জানতে চাইলে বলতেই হবে।
সে শুরু করবে এই ভাবে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে মার ঘরে গিয়ে বলবে, মা… আজ জন্মদিন উপলক্ষে আমি তোমার সঙ্গে তোমার ঘরে ঘুমুব। বাবাকে গেস্ট রুমে ঘুমুতে বলো।
মা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে বলবে–ঠিক আছে, ঘুমুবি।
সে বলবে ছোটবেলায় যেভাবে ঘুমুতাম ঠিক সেইভাবে ঘুমুব। তুমি তোমার চুল খোলা রেখে শুয়ে থাকবে। আমি তোমার চুল শরীরে ফেলে ঘুমুব।
মা আরও খুশি হবে। হাসিমুখে বলবে, সেই লম্বা চুল কী আছে রে মা?
স্বাতীর ছোটবেলার ঘুমের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মায়ের চুল তার সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতে হতো। এই ঘুমের বিশেষ একটা নাম ছিল—–চুল ঘুম। মায়ের চুল ভেজা হলে এই চুল ঘুম দেয়া যেত না। স্বাতী কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলত।
অনেকদিন পর চুল-ঘুমের ব্যবস্থা করে স্বাতী বলবে–মা শোনো, আমি যদি পছন্দের কোনো ছেলেকে বিয়ে করি তাহলে তুমি কি আপত্তি করবে?
মা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক চমকে উঠে বলবে, ছেলেটা কে?
স্বাতী বলবে, ছেলেটা কে সেই প্রশ্ন পরে আসছে। আগে বলো, আমার নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে দিতে তোমার আপত্তি আছে কি-না।
মা নিতান্ত অনিচ্ছায় প্রায় ফিসফিস করে বলবেন না।
তখন স্বাতী বলবে, ভালো ছেলে বলতেই বাবা-মার চোখে যে ছবি ভাসে ঐ ছেলে সে রকম না।
কী করে সে?
সে একজন কবি।
কী সর্বনাশ!
কী সর্বনাশ–বলে লাফ দিয়ে ওঠার কিছু নেই মা। কবিরা ভয়ঙ্কর কোনো প্রাণী না।
করে কী?
বললাম না, কবি। কবিতা লেখে। আর করবে কি?
সংসার চালায় কীভাবে? কবিতা লিখে কি সংসার চলে?
সেটা একটা কথা। কবিতা লিখে সংসার চলে না। তবে সে কবিতা ছাড়া আর কিছু লিখতেও পারে না।
আমার মনে হচ্ছে তুই মিথ্যা কথা বলছিস। তুই ঠিকঠাক করে বল ছেলে করে কী?
মা ও একজন পেইন্টার।
পেইন্টার মানে কী? গাড়িতে যে রঙ করে সেও তো পেইন্টায়।
ও গাড়িতে রঙ করে না মা। কাগজে ছবি আঁকে। অপূর্ব ছবি। ছবি দেখলে তোমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। দেখতেও খুব হ্যান্ডসাম। শুধু বয়স সামান্য বেশি।
সামান্য বেশি মানে কত বেশি?
কত বেশি তা তো বলতে পারব না। জিজ্ঞেস করি নি কখনও। কপালের কাছের কিছু চুল পাকা দেখে মনে হয় বয়স হয়েছে মধ্যবয়স্ক।
পরিচয় হলো কীভাবে?
খুব ইন্টারেস্টিংভাবে পরিচয় হয়েছে। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে একটা বই এনেছিলাম। আমার কাছে থেকে সেই বই নিয়ে গেল যূথী। আর তো বই ফেরত দেয় না, শুধু ফাইন হচ্ছে। শেষে একদিন করলাম কি অফিস থেকে যূথীর ঠিকানা নিলাম। বাসা খুঁজে বের করব। যূথী থাকে ভূতের গলিতে–কলাবাগান হয়ে যেতে হয়। আমি একে-ওকে জিজ্ঞেস করে করে যাচ্ছি–এভাবে ভদ্রলোকের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। খুব সুন্দর এটা বাড়ি। ছায়া ছায়া বাড়ি। শহরের মাঝখানে যেন ছোট্ট একটা বাঁশবনওয়ালা গ্রাম। বাড়ির সামনে জঙ্গলমতো হয়ে আছে। সেই জঙ্গলে ফুটফুটে একটা মেয়ে একা একা খেলছে। মেয়েটাকে দেখে এমন মজা লাগল। আমি বললাম, এই খুকি, এটা কার বাড়ি?