ভান?
অবশ্যই ভান। এক ধরনের প্রতারণা। ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা।
বুঝলি কী করে খেলা?
বোঝা যায়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। যে জন্য বাবা দিনরাত নিজের কাজ নিয়ে থাকে। এই ফার্নিচারের বার্নিশ ঘষছে, ঐ করাত নিয়ে কাঠ কাটছে। মা আছে রান্নাঘরে। অথচ কথা বলার সময় একজনের জন্য অন্যজনের কী গভীর মিথ্যা মমতা!
মিথ্যা মনে করছিস কেন? মমতা তো সত্যিও হতে পারে।
আমি জানি সত্যি না। তারা খেলছে পাতানো খেলা। পৃথিবীটাই পাতানো খেলার জায়গা। এই খেলা তুই হয়ত খেলবি। আমি খেলব না।
লিলি বলল, তোর দার্শনিক কথাবার্তা শুনতে আমার এখন ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব।
চল তোকে দিয়ে আসি। ও আচ্ছা, তোকে বলতে ভুলে গেছি। এর মধ্যে কতবার যে তোর খোঁজে তোর বাবা টেলিফোন করেছেন। তুই নেই বলার পরেও বিশ্বাস করেন নি। একবার নিজে এসে দেখে গেছেন। তুই কি বাসায় কাউকে না। বলে এসেছিস?
হুঁ।
তাহলে তো বাসায় গেলে আজ সর্বনাশ হয়ে যাবে।
হুঁ।
তোর বাবা তোকে কিমা বানিয়ে ফেলবে।
লিলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার হাত কাঁপতে শুরু করেছে।
.
লিলি বাসায় পৌঁছল রাত দশটার একটু আগে। স্বাতী তাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে। সে বাড়ির সামনে নামে নি, লন্ড্রির সামনে নেমে হেঁটে হেঁটে বাসায় গিয়েছে। বাড়ির সদর দরজা খোলা, প্রতিটি বাতি জ্বলছে। বাড়িতে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে তা আলো দেখলে বোঝা যায়। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলে মানুষ যেখামে যত বাতি আছে জ্বেলে দেয়।
লিলি ভয়ে ভয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তাকে প্রথমে দেখল মতির মা। সে একগোছা বাসন-কোসন নিয়ে কলঘরের দিকে যাচ্ছিল। লিবিকে দেখেই–ও আফাগো বলে বিকট চিৎকার দিল। হাত থেকে সম্ভবত ইচ্ছে করেই সব বাসন কোসন ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দ হলো। দোতলা থেকে রুমু ঝুমু একসঙ্গে নিচে নামছে।
বড় চাচা তার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসেছেন।
তিনি বললেন, কোথায় লিলি, আয় দেখি আমার ঘরে আয়।
লিলি ঝুমুর দিকে তাকিয়ে বলল, মা কোথায় রে?
ঝুমু বলল, মার বিকেল থেকে বুকে ব্যথা হচ্ছে। মা শুয়ে আছে। মার ধারণা তুমি আর ফিরে আসবে না।
বাবা! বাবা কোথায়?
বাবা তোমাকে খুঁজতে গেছে।
কোথায় খুঁজতে গেছে?
কোথায় আর খুঁজবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। আর ছোট চাচা গো, হাসপাতালে।
ঝুমু বলল, আমার এতক্ষণ ভয় লাগে নি। এখন ভয় লাগছে। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আপা।
কেন?
মনে হচ্ছ বাবা ফিরে এসে তোমাকে খুনটুন করে ফেলবে।
বড় চাচা বারান্দা থেকে আবারও ডাকলেন, লিলি কোথায়? লিলি বলল, চাচা আপনি ঘরে যান। আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি আয়।
লিলি মার ঘরে গেল। সব ঘরের বাতি জ্বলছে। শুধু এই ঘরের বাতি নেভানো। লিলি দরজা থেকে ডাকল–মা।
ফরিদা বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে পাশ ফিরলেন। চাপা গলায় বললেন, বাতি জ্বালা।
লিলি বাতি জ্বালাল। মায়ের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। একদিন মানুষটা কেমন হয়ে গেছে। যেন একজন মরা মানুষ। তিনি বললেন, তুই ভা.. খেয়েছিস?
লিলির খুবই অবাক লাগছে। তাকে দেখে তার মার প্রথম যে কথাটা মনে হলো। তা হচ্ছে, সে ভাত খেয়েছে কিনা। সব মা কি এ-রকম? না শুধু তার মা? ফরিদ। বললেন, তুই আলুভাজি পছন্দ করিস, তোর জন্য আলুভাজি করেছি।
তোমার কি বুকে ব্যথা খুব বেশি মা?
হ্যাঁ।
হাত বুলিয়ে দেব?
দে।
নেয়ামত সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাত এগারোটার দিকে। লিলি তার ঘরে শুয়ে ছিল। ঝুমু দৌড়ে এসে খবর দিল। ভয়ে কাঠ হয়ে লিলি অপেক্ষা করছে কখন তা ডাক পড়ে। তার ডাক পড়ছে না।
ঝুমু কিছুক্ষণ পর আবার এসে জানালো, বাবা বারান্দায় বসে কাঁদছে।
হ্যাঁ, কান্নার শব্দ লিলি শুনছে। কী বিশ্রী শব্দ করে কান্না!
কান্না থামার পরেও নিয়ামত সাহেব তার মেয়েকে কাছে ডাকলেন না। তিনি এক বৈঠকে এক শ রাকাত নামাজ মানত করেছিলেন। তিনি মানত আদায় করতে জলচৌকিতে উঠে বসলেন।
শুধু নামাজ না, দুটি খাসিও মানত করা হয়েছিল। জাহেদুর রহমান রাতেই আমিনবাজার থেকে খাসি কিনে এনেছে। খাসি দুটি ব্যা ব্যা করেই যাচ্ছে।
লিলিদের যেখানে যত আত্মীয়স্বজন ছিল সবাই আসতে শুরু করেছে। সবার কাছেই খবর গিয়েছে লিলিকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমদাদিয়া মাদ্রাসার এক হাফেজ সাহেবকে সন্ধ্যাবেলায় খবর দিয়ে আনা হয়েছিল কোরান খতম করার জন্য। তিনি সাত পারা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছেন। এখন অষ্টম পারা শুরু করেছেন। বাড়িতে হইচই! কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করছে না। তিনি একমনে কোরান পাঠ করে যাচ্ছে।
রাতে লিলি মরার মতো ঘুমিয়েছে
রাতে লিলি মরার মতো ঘুমিয়েছে একবার শুধু ঘুম ভেঙেছে, তখন দেখে মা তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন। সে ঘুমঘুম গলায় ডাকল, মা! ফরিদা তৎক্ষণাৎ বললেন, কি গো মা।
কিছু না ঘুমাও। বলেই লিলি ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। ঘরের ভেতর আলো, বিছানায় চনমনে রোদ। ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ সে বিছানায় শুয়ে রইল। এক ফাঁকে ঝুমু এসে উঁকি দিল। ঝুমুর ঠোঁটের ফোলা কমেনি–আরও মন হয় বেড়েছে। তার মুখ লালচে হয়ে আছে। কাল রাতে লিলি এটা লক্ষ করে নি।
তোর ঠোঁটের অবস্থা তো খুব খারাপ।
হুঁ।
ব্যথা করছে না?
করছে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার তো।