এক সময় কুসুম বলল, আফনের পেট ভরছে? লোকটা ধড়মড় করে উঠল। কুসুম যে এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়েছিল সে বুঝতে পারেনি।
অযত্ন হইলে ক্ষমা দিবেন। মার শইলডা ভালা না।
অযত্ন হয় নাই।
পুষ্প, যা পান বানাইয়া আন।
পুষ্প পান আনতে গেল। কুসুম ঘরে ঢুকল।
গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে বাড়ি, তার উপর বলতে গেলে নিশুতি রাত। সে কি করছে না করছে দেখার কেউ নেই। কুসুমকে ঢুকতে দেখে সুরুজ আরও হকচকিয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল। কুসুম বলল, বসেন বসেন। সুযোগ বুইজ্জ্যা দুইটা কথা বলতে আসছি।
সুরুজ বলল, কি কথা?
কুসুম সঙ্গে সঙ্গে বলল, ব্যাঙের মাখা।
সুরুজ অকিয়ে আছে অবাক হয়ে। কুসুম বলল, আমার কথায় অবাক হইয়েন। আমি জ্বীনে ধরা মেয়ে। আমার কথাবার্তা কাজকর্মের ঠিকঠিকানা নাই।
সুরুজ বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বীনে ধরা?
হুঁ। অনেক তাবিজাবিজ দিছে। তাবিজে কাজ হয় না। আফনে চিন্তা কইবেন, বিয়ার পরে জ্বীন থাকে না।
কুসুম চৌকির উপর বসল। সহজ ভঙ্গিতেই বসল। যেন অনেক দিনের চেনা মানুষের সঙ্গেই গল্প করতে বসেছে। পুষ্প পান নিয়ে এসে কুসুমের চোখের দিকে তাকাল। কুসুম বলল, থালাবাটি লইয়া ভিতরে যা পুষ্প, আমি আসতাছি।
পুষ্প থালাবাটি নিয়ে চলে গেল। কুসুম সুরুজের দিকে পানদান এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আফনেরে সবের খুব পছন্দ হইছে। আমারও হইছে।
সুরুজ খুক খুক করে কাল।
কুসুম বলল, জ্বীনের কথা শুইন্যা ভয় পাইয়েন না। পুরুষ মানুষের ভয় ভাল জিনিশ না। আর জ্বীন তো আমারে রোজদিন ধরে না, মাঝে মইধ্যে ধরে।
সুরুজ ক্ষীণ স্বরে বলল, তখন কি হয়?
এইসব আফনের শুইন্যা লাভ নাই। আমার যে বিয়া হয় না, এই কারণেই হয় না। কত সম্বন্ধ আইল, কত সম্বন্ধ ভাঙল। নেন, পান খান।
কুসুম নিজেই পান এগিয়ে দিল। সুরুজ পান নিল ভয়ে ভয়ে। কুসুম বলল, এক রাইতে কি হইছে শুনেন–জ্বীনের আছর হইছে–নিশুঁত রাইত, আমি দরজা খুইল্যা বাইর হইছি। উপস্থিত হইছি মতি ভাইয়ের বাড়িতে। ছিঃ ছিঃ, কি কেলেঙ্কারি! মতি ভাই থাকে একলা। জোয়ান পুরুষ, সে দরজা খুইল্যা আমারে দেইখ্যা অবাক। আমার কথা শুইন্যা মনে কিছু নিয়েন না। আফনেরে আপন ভাইব্যা বলতেছি।
সুরুজ আবার কাশল। তার মুখ ভর্তি পান। কিন্তু সে পান চিবুতে পারছে না। কুসুম ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আফনে ঘুমান। রাইত মেলা হইছে।
কুসুম ঘর থেকে বের হয়ে দেখল, অন্ধকারে দরজার ওপাশে পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। সে থালাবাটি নিয়ে চলে যায়নি, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। পুষ্প নরম গলায় বলল, বুবু, তুমি নিজেই বিয়া ভাইঙ্গা দিলা!
কুসুম বলল,। কাউরে কিছু বলিস না পুষ্প। আমি কাউরে কিছু বলব না, কিন্তুক সুরুজ ভাই বলব। বাপজানরে বলব।
না, সেও কিছু বলব না। কাউরে কিছু না বইলা পালাইয়া যাইব।
উহুঁ।
কুসুম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, উহুঁ বলছস ক্যান?
সুরুজ ভাই পালাইব না। তোমারে তার খুব মনে ধরছে। জ্বীন-ভূতের কথা বইল্যা তারে খেদাইতে পারবা না।
ব্যথায় মনোয়ারা সারারাত কষ্ট পেলেন। মোবারক ফিরলেন মাঝরাতে—খালি হাতে। রাজবাড়ির মেয়ের লেখা ওষুধ নিন্দালিশ বাজারের ফার্মেসিতে পায় গেল না।
ভোরবেলা ব্যথা কমে গেল। মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলেন–কুসুমের বিয়ে হচ্ছে। চারদিকে বাদ্যবাজনা বাজছে। রাজবাড়ির মেয়েটা এসে কুসুমকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সে কালো একটা বাক্সভর্তি গয়না নিয়ে এসেছে। বাক্স থেকে গয়না নিয়ে একের পর এক পরিয়ে দিচ্ছে। পাথর বসানো কি সুন্দর ঝলমলে গয়না!
সুখানপুকুর নামের মানে কি
নীতু বলল, সুখানপুকুর নামের মানে কি আপা?
শাহানা বলল, যে পুকুর শুকিয়ে গেছে সেই পুকুরই সুখানপুকুর।
তাহলে তো বানান হওয়া উচিত তালিব্য শ দিয়ে…
শাহানা বিরক্ত গলায় বলল, তোকে নিয়ে বের হবার প্রধান সমস্যা হল–তুই খুব তুচ্ছ জিনিশ নিয়ে জটিল তর্কে যেতে চাস।
নীতু বলল, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হবার প্রধান সমস্যা কি তুমি জান?
না।
প্রধান সমস্যা হল–সব সময় তোমার মুডের উপর লক্ষ্য রাখতে হয়। তোমার দিকে লক্ষ্য রেখে কথা বলতে হয়। মোহসিন ভাই তোমাকে বিয়ে করে কি ভয়ংকর বিপদে যে পড়বে তা সে জানে না।
জানিয়ে দিস।
আসলেই জানানো উচিত। উনি এলেই প্রথম এই কথা বলব।
শাহানা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি এলেই মানে? সে আসছে না-কি?
হুঁ।
হুঁ মানে কি? পরিষ্কার করে বল।
উনি আসছেন, মিতু আপা আসছে।
কেন?
দাদাজান তাদের আনার জন্যে নে কখন আসবে?
আজ ভোরবেলা এসে পৌঁছানোর কথা। এই জন্যেই আমি তোমার সঙ্গে বের হতে চাইনি। তুমি জোর করে নিয়ে এলে।
দাদাজান হঠাৎ ওদের নিয়ে আসছেন কি জন্যে?
সেটা দাদাজানই জানেন। সম্ভবত তোমাকে অবাক করে দিতে চান।
আমাকে অবাক করবার তার দরকারটা কি?
তোমাকে উনি খুবই পছন্দ করেন। আমরা যাদের পছন্দ করি তাদের অবাক করে দিতে আমাদের ভাল লাগে।
শাহানা বিরক্ত বোধ করছে। মিতু আসছে আসুক। মিতুর সঙ্গে মোহসিন আসছে কেন? বিয়ের আগের সময়টা সে নিজের মত করে থাকতে চায়? নীতু বলল, তুমি মুখটা এমন কাল করে ফেললে কেন? মোহসিন ভাই আসছে এতে তো তোমার আনন্দিত হবার কথা। এখন আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে তোমাকে ঘুরতে হবে না। তুমি। সঙ্গী পেয়ে গেলে।
এত কথা বলিস না তো নীতু, মাথা ধরে যাচ্ছে।
আচ্ছা আর কথা বলব না। এখন থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সাইন ল্যাংগুয়েজে জবাব দেব। আপা, তুমি কি সাইন ল্যাংগুয়েজ জান? আমি তোমাকে ভালবাসি এটা সাইন ল্যাংগুয়েজে কি ভাবে বলা হয়?