এই পরিস্থিতিতে আমার কি করণীয়? আমি শাহানা। মেডিক্যাল কলেজের সর্বকালের সেরা কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের একজন। প্রতিটি বিষয়ে আমি ডিসটিংশন পেয়েছি। রাষ্ট্রপতির দেয়া গোল্ড মেডেল আমাদের বসার ঘরের আলমিরায় সাজানো। আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। আমি কোন কিছুই ভুলি না–। মেডিসিনের প্রফেসর জালাল উদ্দিন ভাইভা বোর্ডে হাসতে হাসতে বলেছিলেন–মাই লিটল গার্ল, ইউ হ্যাভ এ ফটোগ্রাফিক মেমোরী।
কিন্তু শাহানার কিছু মনে পড়ছে না। এই পরিস্থিতিতে তাকে কি করতে হবে–গাইনীর প্রফেসার ভূঁইয়া ক্লাসে একদিন বলেছিল–প্রসবকালীন সময়ে মন থেকে মায়া জিনিশটা সরিয়ে দিও। কারণ মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যে, মায়ার কারণে মা এবং শিশু দুজনকে তুমি রক্ষা করতে যাবে–দুজনকেই হারাবে। সে সময় মায়া কম থাকলে–অন্তত একজন রক্ষা পাবে।
শাহানা কি করবে? একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে? কাকে বাঁচাবে? মাকে, শিশুটিকে? শাহানা খোদেজার মার দিকে তাকিয়ে বলল–গরম পানি আছে? হাত ধোব।
খোদেজার মা গামলায় গরম পানি নিয়ে এল। এই পানিতে জীবাণুনাশক কিছু দেয়া হয়নি। জীবাণুনাশকের জন্যে অপেক্ষা করারও কোন অর্থ হয় না। পানি অতিরিক্ত গরম–শাহানা সেই গরম অনুভব করছে না। শীত-গরমের সংবাদ যে স্নায়ু মস্তিষ্কে পৌঁছায় সেই স্নায়ু অসাড় হয়ে আছে। তার সমস্ত চেতনাই অসাড়।
খোদেজার মা বলল, আফা কি করবেন অখন? . কি করবে শাহানা নিজেও জানে না। তার কি করা উচিত তা যদি একজন কেউ বলে দিত! দূর থেকে শুধু যদি বলত–শাহানা, এখন এটা কর এখন ওটা কর। শাহানা করত। নির্ভুলভাবে করত। শাহানকে বলে দেবার কেউ নেই।
ভূঁইয়া স্যার একবার ক্লাসে বলেছিলেন–মেডিকেল প্রফেশনে মাঝে মাঝে তোমরা ভয়াবহ সমস্যায় পড়বে। তখন আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। দেখবে এতে নার্ভের জড়তা কেটে যাবে। সহজভাবে চিন্তা করতে পারবে।
শাহানা বলেছিল, নার্ভের জড়তা কে কাটিয়ে দেন? আল্লাহ?
স্যার বলেছিলেন, হয়ত তিনিই কাটান। কিংবা হয়ত তার কাছে প্রার্থনা করার কারণে নিজের মনের ভেতর থেকে এক ধরনের শক্তি আসে।
যে আল্লাহ ডাক্তারের নার্ভের জড়তা কাটান তিনি কেন সরাসরি রোগিকে সুস্থ করে দেন না?
সেটা উনি বলতে পারবেন। আমি পারব না। উনার কর্ম পদ্ধতি বোঝা মানুষের সাধ্যের বাইরে।
শাহানা কঠিন গলায় বলেছিল, স্যার, আমার ধারণা, আল্লাহ্ ধর্ম এইসব মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেন নি। ম্যান ক্রিয়েটেড গড।
হতে পারে। এটা যেহেতু ধর্মতত্ত্বের ক্লাস না সেহেতু আমরা আমাদের টপিকে ফিরে যাই–শরীরতত্ত্ব।
আজ এতদিন পর তার কেন মনে হচ্ছে–আল্লাহ বলে একজন কেউ থাকলেও থাকতে পারেন। তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।
শাহানা বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, ও গড অলমাইটি, প্লীজ হেল্প মি। প্লীজ হেল্প মি।
খোদেজার মা আবার বলল, আফা, অখন কি করবেন?
শাহানা শান্তস্বরে বলল, পেটের ভেতর শেষ মুহূর্তে বাচ্চা উল্টে দেয়ার একটা প্রাচীন পদ্ধতি আছে। ঐটা চেষ্টা করব। একবারই করব…
যদি না হয়…
যদি না হয়, যদি পদ্ধতি কাজ না করে তখন কি হবে শাহানা তা বলতে পারছে না। তার কপালে ঘাম জমছে–হাত আবারও কাঁপছে। পদ্ধতিটা কি সে জানে? ভাসাভাসা জানে। ব্রাকষ্টোন হাইক পদ্ধতি। পুরোনো দিনের একজন অসাধারণ ডাক্তার প্রফেসর ব্রাকষ্টোন হাইক এই পদ্ধতি বের করে অনেক জীবন রক্ষা করেছেন। এই পদ্ধতির কোন প্রচলন এখন নেই–আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র প্রাচীন। সব পদ্ধতিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে–
প্রথমে বাচ্চার পা খুঁজে বের করতে হবে। তিনটি আঙুলে দুটি পায়ের গোড়ালি ঠেলে ধরতে হবে। তারপর সামান্য উপরের দিকে ঠেলে ধরতে হবে। উপরের দিকে ঠেলার সময়টা সিনক্রোনাইজড হতে হবে জরায়ুর প্লাসমের সাথে, একটা হাত থাকবে বাইরে পেটের উপর–বাচ্চার মাথার কাছাকাছি। বাইপোলার পদ্ধতি–এক হাতে বাচ্চার পা ঠেলে দেয়া, এক হাতে মাখার নিচের দিকে চাপ দেয়া। শাহানা কি পারবে? বই পড়া বিদ্যা এবং বাস্তব ক্ষেত্র আলাদা। অভিজ্ঞতা শাহানাকে কোন সাহায্য করছে না। তার অভিজ্ঞতা শূন্য। শাহানা মনে মনে ইংরেজিতে বলল, আই স্টার্ট বাই দ্যা নেম অব গড। গড অলমাইটি, হেল্প মি।
শাহানা কি পারছে? শিশুটি সাড়া দিচ্ছে শাহানার আঙুলের ইশারায়? শিশুটির একটি পা পাওয়া গেছে–আরেকটি পা কোথায়? প্রেসেন্টার নালী যদি পায়ে পেঁচিয়ে থাকে তখন কি করণীয়…? ঘামে শাহানার কপাল ভিজে গেছে। ভুরু ছাপিয়ে সেই ঘাম তার চোখের দিকে আসছে। সে শান্ত গলায় খোদেজার মার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার কপালের ঘাম মুছে দিন। বাঁ হাতটা সে শিশুর মাখার উপর রেখেছে। ডান হাতে সে খুঁজছে শিশুটির পা। তার নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। শিশুর দ্বিতীয় পাটি পাওয়া যাচ্ছে না।… এই তো, এই তো পাওয়া গেছে। ও গড প্লীজ হেল্প মি।
আধো তন্দ্রা আধো জাগরণের ভেতর দিয়ে দূর্গা শুনছে খোদেজার মার আনন্দিত গলা–দেখ, তোমার কন্যারে দেখ। কি সুন্দর কন্যা!
দূর্গা অনেক কষ্টে চোখ মেলল। কই, সে তার বাচ্চাটাকে তো দেখছে না–সে দেখছে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়েকে এই সুন্দর মেয়েটা কে? কার বাড়ির মেয়ে? সে এখানে কেন?