তোমার কি মনে হয় আমার মৃত্যুর পর শুভ্র আমার ব্যবসা দেখবে?
জ্বি না। স্যার, দেখবে না। তবে…
তবে আবার কী?
মানুষ বদলায়…
মোতাহার সাহেব। আবারো চেয়ারে পা তুলতে তুলতে বললেন, এটা তো ছালেহ তুমি ভুল কথা বললে। কিছুই বদলায় না। একটা বড় পাথর ক্ষয় হয়ে ছোট পাথর হয়। কিন্তু পাথর পাথরই থাকে। মানুষের বেলাতেও এটা সত্যি। মানুষও পাথরের মত। শুভ্ৰ বদলাবে না। এখন যে রকম আছে পঞ্চাশ বছর পরেও তাই থাকবে।
ঠিক বলেছেন। ছোট বাবুর জন্যে কথাটা খুব সত্যি।
শুধু ছোট বাবুর জন্যে সত্যি না। সব বাবুর জন্যেই সত্যি। যে সৎ সে জন্ম থেকেই সৎ, যে অসৎ সে জন্ম থেকেই অসৎ।
ছালেহ কিছু বললেন না। তাঁর চোখের উদ্বেগ আরো বাড়ল। বড় সাহেবের শরীর খারাপটা কোন পর্যায়ের তা তিনি ধরতে চেষ্টা করছেন।
মোতাহার সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার মৃত্যুর পর আমার ব্যবসা কে দেখবে?
ছালেহ চুপ করে রইলেন। মঞ্জু ঘরে ঢুকল। তার হাতে কর্ডলেস টেলিফোনের রিসিভার। মঞ্জু কঁচুমাচু মুখে বলল, আম্মার ফোন। টেলিফোনের শব্দে মোতাহার সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে যায় বলে টেলিফোন সেট দোতলায় রাখা। জরুরি। টেলিফোন হলেই মঞ্জু রিসিভার নিয়ে ছুটে আসে। নিতান্ত জরুরি না হলে মোতাহার সাহেব টেলিফোন ধরেন না। টেলিফোনে সূক্ষ্ম এক ধরনের শব্দ হয়— যে শব্দ অন্য কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু তিনি শুনতে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে।
মোতাহার সাহেব রিসিভার কানে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন, হ্যালো জাহানারা। কী ব্যাপার?
জাহানারা উত্তেজিত গলায় বললেন, তুমি কি আজ দুপুরে বাসায় খাবে?
কেন?
ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছে, তোমার আসা দরকার। অফিসে যদি তেমন কোনো কাজ না থাকে তুমি চলে এসো।
ঘটনাটা কী?
বাসায় আস তারপর বলি। সব কিছু কি আর টেলিফোনে বলা যায়!
জরুরি কাজ আছে, আসতে পারব না। ঘটনা। কী বল।
টাকা চুরি গেছে।
ও আচ্ছা।
পাঁচশ টাকার তিনটা নোট। খাবার ঘরে যে হলুদ ম্যাট আছে। ম্যাটের নিচে রেখেছিলাম। দুধের বিলের টাকা। দুধের বিল প্লাস টাকা। বিলটা আছে, নোট তিনটা নেই।
ও।
টাকাটা কে নিয়েছে আমি বের করেছি। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। টাকাটা নিয়েছে বিনু। উচ্চ শিক্ষার জন্যে যিনি ঢাকা এসে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন সেই বিনু।
তুমি তাকে কিছু বলেছ?
এখনো কিছু বলি নি।
ভাল করেছ। আমি এসে যা বলার বলব। টাকা চুরি গেছে এটা সে জানে?
হ্যাঁ জানে। ভাল মানুষের মত সে নিজেও খোঁজাখুঁজি করছে। এই খাটের নিচে ঝাঁট দিচ্ছে, এই বালিশ উল্টাচ্ছে। কত বড় হারামজাদি ভাবছে তার অভিনয় কেউ বুঝতে পারছে না।
তুমি কিছু বলো না।
আমি বলব না। কিন্তু এই চুরানী মেয়েকে তুমি আজই বিদায় করবে। দরকার হলে হোটেলে ঘর ঠিক করে দিবে। হোটেলে থাকবে। এই চুরুনীর সঙ্গে আমি এক ছাদের নিচে থাকব না।
আচ্ছা। শুভ্র কোথায়?
ঘরেই আছে। কথা বলবে?
না।
তুমি কি শুভ্ৰকে বিকেলে গাড়ি দিতে পারবে? সে তার কোন বন্ধুর বাসায় যাবে। শুভ্র অবশ্য বলছে গাড়ি নেবে না। কিন্তু গাড়ি ছাড়া ওকে আমি কোথাও যেতে দেব না। আজই পত্রিকায় দেখেছি – রিকশা করে এক হাসবেন্ড-ওয়াইফ। যাচ্ছিল, পেছন থেকে ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে, মেয়েটা মারা গেছে। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় নিউজটা আছে। ছবি দিয়ে ছেপেছে। তোমার অফিসে ইত্তেফাক রাখা হয়?
না।
তাহলে কাউকে দিয়ে ইত্তেফাকটা আনিয়ে নিউজটা পড়।
আচ্ছা পড়ব।
টেলিফোনের পাতলা রিনারিনে শব্দ মোতাহার সাহেবকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। এতক্ষণ তিনি রিসিভার কানের সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছিলেন, এখন একটু দূরে সরিয়ে রাখলেন। জাহানারার সঙ্গে কথা বলার প্রধান সমস্যা হল জাহানারা কিছুতেই টেলিফোন ছাড়তে চায় না। কথা বলার মত প্রসঙ্গ তার থাকেই।
হ্যালো হ্যালো।
শুনতে পাচ্ছি।
তোমার অফিস থেকে কাউকে বলবে যেন একজন গ্যাসের চুলার মিস্ত্রি নিয়ে আসে। চুলটার কী হয়েছে গ্যাসের কোনো প্রেসার নেই।
বলব।
তোমার গলার স্বর এরকম কেন? শরীর খারাপ করছে?
না, শরীর ঠিক আছে। জাহানারা এখন রাখি- একটা জরুরি কাজ করছি।
মোতাহার সাহেব টেলিফোন রিসিভার মঞ্জুর হাতে দিতে দিতে বললেন, মঞ্জু আরেক কাপ চাপ দে। কড়া করে দিস। পানসে চা খেতে পারি না।
মঞ্জু আগের কাপটা নিয়ে চলে গেল। ভরা কাপ। মোতাহার সাহেব একটা চুমুকও দেন নি। ছালেহ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, স্যার একজন ডাক্তার নিয়ে আসি প্রেসারটা মাপুক।
মোতাহার সাহেব ডাক্তার লাগবে না। এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর শরীরটা দ্রুত খারাপ করছে। আগে বমি ভাব ছিল না। এখন বমি ভাব হচ্ছে। বিশ্ৰী গন্ধ অনেকক্ষণ ধরে নাকে আসছে বলেই বমি ভাব হচ্ছে।
ছালেহ।
জ্বি স্যার।
বাসায় একজন গ্যাসের চুলার মিস্ত্ৰি পাঠাতে হবে।
জ্বি আচ্ছা!
তুমি একটু ব্যাংকে যাও- কিছু ক্যাশ টাকা নিয়ে আসা। ব্যাংক খোলা আছে না?
জ্বি খোলা আছে।
নতুন নোট আনবে। একশ টাকার নতুন নোট।
জ্বি আচ্ছা।
পঞ্চাশ টাকার নোটও এন। নতুন হয় যেন। পুরনো না। ব্যাংকে যদি নতুন নোট না থাকে তুমি মানি চেঞ্জারদেরকে দিয়ে নতুন নোটের ব্যবস্থা করবে।
জ্বি আচ্ছা।
মোতাহার সাহেব মানিব্যাগ খুলে চেক বের করে দিলেন। চেক আগেই লেখা ছিল। ছালেহ চেকের ওপর চোখ বুলিয়ে বিস্মিত চোখে তাকাল। তিন লাখ টাকার চেক। হঠাৎ করে এত ক্যাশ টাকার দরকার পড়ল কেন? তাও সব নতুন নোট।