জাহানারা কাঁদো কাদো গলায় বললেন, তুই যা ভাবছিস সব মিথ্যে। আমি তোকে পেটে ধরেছি। তুই আমার সন্তান। ছেলে। সবাই এটা জানে।
শুভ্র সহজ গলায় বলল, মা আমি অবশ্যই তোমার সন্তান। সন্তান হতে হলে পেটে ধরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি হলাম মূর্তিমান পাপ। এই পাপকে তুমি গভীর মমতায় বুকে তুলে নিয়েছ। তুমি আমার কাছে পৃথিবীর শুদ্ধতম রমণী। আমি যদি আরো একশবার পৃথিবীতে জন্মাই এবং আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, শুভ্ৰ তুমি কোথায় জন্ম নিতে চাও? আমি অবশ্যই বলব আমি যেখানেই জন্মাই না কেন আমাকে কোনো-না-কোনো সময় যেন আমার মার কোলে পৌঁছে দেয়া হয়। সেই মা তুমি।
জাহানারার শরীর কাঁপছে। তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। শুভ্ৰ মার দিকে আরেকটু ঘেঁসে এসে বলল, সত্যিকার ভালবাসা মানুষকে পবিত্র করে। তোমার ভালবাসায় আমি পবিত্র হয়েছি। বাবাকে তুমি কখনোই ভালবাসতে পার নি বলে বাবাকে পবিত্র করতে পার নি। তুমি ইচ্ছা করলেই পারতে।
শুভ্ৰ চুপ করে থাক।
আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। জ্বরের সময় মানুষ ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তখন প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমারও তাই হয়েছে। জ্বরটা মাথায় ঢুকে পড়েছে।
জাহানারা ছেলের মাথায় হাত রেখে চমকে উঠলেন। জ্বর দ্রুত বাড়ছে। শরীর দিয়ে তাপ বের হচ্ছে।
শুভ্ৰ বলল, ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে আমি যাই। চুপচাপ বসে থাকি। কী অদ্ভুত যে আমার লাগে! এইখানে আমার জন্ম। কী আশ্চর্য!
শুভ্ৰ, অন্য কথা বল।
অন্য কী কথা? সুন্দর কিছু? যার জন্ম হয়েছে অসুন্দরে সে সুন্দর কিছু কীভাবে বলবো? তাছাড়া আজ আমার মনটাও খারাপ।
মন খারাপ কেন?
আসমানী বলে একটা মেয়ে ছিল। খারাপ মেয়ে। মেয়েটার অসম্ভব বুদ্ধি। মেয়েটা মারা গেছে।
কীভাবে মারা গেছে?
মারা গেছে এটাই মূল কথা। কীভাবে মারা গেছে সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণনা। শুনেছি বিষ খেয়ে মারা গেছে। আবার কেউ কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঐসব জায়গায় জন্ম যেমন গুরুত্বহীন মৃত্যুও গুরুত্বহীন।
গুরুত্বহীন হলে তুই মন খারাপ করছিস কেন?
গুরুত্বহীন কেন এটা ভেবেই মন খারাপ করছি। তবে এই মন খারাপ বেশিক্ষণ থাকবে না। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যদি নোংরা কিছুর উপর পা পড়ে তখন সারা শরীর ঘিনীঘিন করতে থাকে। নোংরাটা ধুয়ে ফেলতেই ঘিনঘিনে ভাব দূর হয়ে যায়। কিন্তু মা রাস্তার ঐ নোংরাটা কিন্তু দূর হয় না। থেকেই যায়।
শুভ্ৰ, তোর জ্বর খুব বেড়েছে। একজন ডাক্তারকে খবর দেই?
দাও। আর শোন মা, বিনুকে একটু পাঠাও।
জাহানারা ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আবার কেন জানি শান্তি শান্তিও লাগছে। তাঁর বুকের উপর ভয়ঙ্কর একটা পাথর চেপে বসে ছিল। মনে হচ্ছে সেই পাথরটা নেই।
বিনুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই শুভ্র বলল, বিনু তুমি কেমন আছ?
বিনু বলল, ভাল। শুভ্র বলল, আমি ভাল নেই। আমার খুব জ্বর। তুমি আমার সামনের এই চেয়ারটায় বস।
বিনু বসল।
শুভ্ৰ জড়ানো গলায় বলল, বিনু তুমি একবার বলেছিলে না আমি নিম্নশ্রেণীর মানুষ? তোমার কথা ঠিক না। আমি জন্মসূত্রে নিম্নশ্রেণীর তো বটেই কিন্তু আমাকে বদলে ফেলা হয়েছে। নিজেকে আমি শুদ্ধ ও পবিত্র মানুষ বলে মনে করছি।
বলতে বলতে শুভ্ৰ উঠে বসতে চেষ্টা করল। পারল না। বিছানায় শুয়ে হাঁপাতে লাগল।
বিনু শান্ত গলায় বলল, আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনি নিজেকে যা মনে করেন। আপনি তাই। আপনি কী তা বের করা একমাত্র আপনার পক্ষেই সম্ভব।
বিনু আমি ঠিক করেছি একটা আশ্ৰম দেব! দুঃখী মেয়েরা যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই তারা এসে এই আশ্রমে আশ্রয় নেবে। আমি খুব খুশি হব। তুমি যদি এই আশ্রমটা তৈরির ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর। আমার বুদ্ধি কম। কাজেই আমাকে সাহায্য করার জন্যে খুব বুদ্ধিমান কিছু মানুষ দরকার।
আপনার কোনো সাহায্য লাগবে না। আপনি একাই পারবেন।
না, পারব না। বিনু মন দিয়ে শোন— আমি কয়েকদিন হল চোখে কিছুই দেখছি না। তুমি হয়ত লক্ষ কর নি। আমি এখন সারাক্ষণ চশমার কাচ ঘষাঘষি করি। মনে মনে ভাবি— চশমার কাচ পরিষ্কার করে কিছু হবে। আমি ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম। আমি যা আশঙ্কা করছিলাম ডাক্তারও তাই বললেন।
বিনু তাকিয়ে আছে। তার চোখে গভীর বিষাদ এবং গভীর বিস্ময়।
শুভ্র সহজ গলায় বলল, আমি এমনভাবে চলাফেরা করছি যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে, বিশেষ করে মা। উনি সব সহ্য করতে পারবেন; আমি চোখে দেখতে পারছি না, এটা সহ্য করতে পারবেন না। বিনু, আশ্রম তৈরিতে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
করব।
বিনু তোমাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে! কথাটা হল— আমি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাবার আগে কিছুক্ষণ ক্যাসেটে তোমার রেকর্ড করা হাসি শুনতাম। না শুনলে আমার ঘুম হত না। এমন কোনো রাত নেই যে তোমার হাসি আমি শুনি নি।
কাল রাতে শুনেন নি।
হ্যাঁ ঠিক বলেছ। কালরাতে শুনি নি। আমার এই ব্যাপারটা তুমি জানতে?
আপনার সবকিছুই আমি জানি।
বিনু এগিয়ে এসে শুভ্রর কপালে হাত রাখল। এবং হাত সরিয়ে নিল না। শুভ্র মনে মনে বলল— মার ভালবাসায় আমি এতদূর এসেছি। এখন নিজেকে সমর্পণ করলাম তোমার কাছে। তুমি তোমার ভালবাসা দিয়ে আমাকে পবিত্র করা। আমি শুদ্ধতম মানুষ হতে চাই।