আমি শান্ত গলায় বললাম, আমার বাবা ছিলেন একজন উচ্চ শ্রেণীর মানুষ। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি আমাকে শেখাতে পেরেছেন। আপনি অনেক কিছু জেনেও আসল জিনিসটা জানেন না। আপনি ভাল মন্দ জানেন না। আপনার কাছে ভাল যা মন্দও তা। আপনি কিছু মনে করবেন না। অনেক কঠিন কথা বললাম।
শুভ্ৰ চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন। তিনি চোখ থেকে চশমা কেন খুলছেন আমি জানি। এই মুহুর্তে তিনি আমাকে দেখতে চাচ্ছেন না। তাঁকে মুখে বলতে হল না, বিনু, তোমাকে আমার অসহ্যবোধ হচ্ছে। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তিনি চশমা খুলে ফেলে আমাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন। কোনো কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার জন্যেই তিনি আলাদা। অন্য সবার চে আলাদা। এই বিশেষ ক্ষমতা ছাড়া তার আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
শুদ্ধতম মানুষ হতে চাই
শুভ্ৰ তোর না-কি শরীর খুব খারাপ?
জাহানারা ছেলের ঘরে ঢুকে হাহাকারের মতো প্রশ্নটা করলেন। শুভ্ৰ দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে শুয়েছিল। মার দিকে ফিরুল। হাসল। বালিশের পাশে রাখা চশমা চোখে দিতে দিতে বলল, শরীর সামান্য খারাপ।
জাহানারা হাত বাড়িয়ে ছেলের কপাল স্পর্শ করলেন। গা জুরে পুড়ে যাচ্ছে। জুরের ঘোরে শুভ্রর মুখ লালচে হয়ে আছে। শরীর সামান্য কাঁপছে। জাহানারা বললেন, তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে রে।
শুভ্ৰ বলল, গা পুড়ে যাওয়াইতো ভাল মা। অনেক ধাতু আছে আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করা হয়। আমাকেও করা হচ্ছে। তুমি এমন অস্থির হয়ে না। কোনো ছুটাছুটি না, ডাক্তার ডাকাডাকি না। তুমি চুপ করে আমার পাশে বসে থাক।
ডাক্তার ডাকব না? তুই এইসব কী বলছিস?
জ্বরটা আমার ভাল লাগছে। কেমন যেন ঘোরের মতো হয়েছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় খাটটা দুলছে, আবার চোখ খুললে দেখি সব ঠিক আছে। জড়ানো গলায় কথা বলছি। নিজের জড়ানো গলার স্বর শুনতেও ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে অচেনা একজন কেউ কথা বলছে। মা দাঁড়িয়ে থেকে না। বস।
জাহানারা বসলেন। শুভ্ৰ তার হাত ধরে ফেলে ছেলেমানুষী গলায় বলল, তোমাকে এ্যাৱেষ্ট করে ফেললাম। এখন আর যেতে পারবে না।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। শুভ্রর ঘরে টেবিলের ওপর টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। ঘরের ভেতর কেমন দমবন্ধ গুমটি ভাব। মাথার ওপর ফ্যান অবশ্য ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে গুমটি দূর হচ্ছে না। জাহানারা বললেন, হাতটা ছাড়, আমি থার্মোমিটার এনে জ্বরটা দেখি।
জ্বর দেখতে হবে না। তুমি চুপ করে বসে থাক। আমার জ্বর কত আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি- একশ তিন-এর সামান্য বেশি। ছোটবেলায় যখন আমার জ্বর আসতো তুমি আমার মাথার কাছে বসে গুটুর গুটুর করে নানান গল্প করতে। আমার খুবই ভাল লাগতো। জ্বর হবার জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করতাম।
কী অদ্ভুত কথা বলছিস? জ্বর না হলে আমি বুঝি গল্প বলতাম না? শুভ্রর সম্ভবত নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বড় বড় শ্বাস নিয়ে সহজ হল। জাহানার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। তাঁর ফোঁপানির শব্দ আসছে।
বলতে। কিন্তু আমার জ্বরের সময় তোমার গল্পগুলো হতো অন্য রকম। খুব মায়া নিয়ে গল্প বলতে।
জাহানারা ধরা গলায় বললেন, বেটারে আমি যখন তোর সঙ্গে কথা বলি মায়া নিয়েই বলি। আমার মনে হয় না পৃথিবীর কোনো মা তার ছেলের সঙ্গে এতো মায়া নিয়ে কথা বলে। তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?
করছি।
জাহানারা শুভ্রর কপালে হাত দিলেন। শুভ্র বলল, ইস তোমার হাতটা কী ঠাণ্ডা!
তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। আমি তোর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
শুধু হাত বুলিয়ে দিলে হবে না গল্প বলতে হবে।
আমার দূরসম্পর্কের এক খালার গল্প শুনবি?
যাকে জীনে ধরে সুপারি গাছের মাথায় বসিয়ে রেখেছিল। এই গল্প দশবার করে শুনে ফেলেছ- অন্য গল্প বল।
শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করে আছে। জাহানারা গল্প মনে করার চেষ্টা করছেন। মজার কোনো গল্পই মনে পড়ছে না।
তার ভাগ্যটাই এমন। প্রয়োজনের সময় কিছু মনে পড়ে না। ছেলেটার শরীর খারাপ। অগ্রহ করে গল্প শুনতে চাচ্ছে অথচ কোনো গল্প মনে আসছে না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা যাবে না। শুভ্ৰ ধরে ফেলবে।
শুভ্ৰ কত হয়ে মার দিকে তাকাল। জাহানারা বললেন, মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে গল্প বলি?
শুভ্ৰ বলল, না। তুমি নড়বে না। মা শোন, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন এক বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে মজার মজার গল্প বলতেন।
কার কথা বলছিস?
বাবার অফিসে কাজ করতেন। তুমি তখন খুব অসুস্থ। ভদ্রলোকের দায়িত্ব ছিল আমাকে স্কুল থেকে অফিসে নিয়ে আসা। আমরা রিকশা করে আসতাম। সারাপথ তিনি গল্প করতেন।
ও।
ভদ্রলোককে তুমি চিনতে পারছ?
না, আমি কীভাবে চিনব? তোর বাবার অফিসের কাউকে আমি চিনি না।
শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করে খুবই শান্ত গলায় বলল, ঐ বুড়ো ভদ্রলোক একবার আমাকে আমাদের ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। খারাপ মেয়েগুলির কাছে।
জাহানারা আতঙ্কিত গলায় বললেন, তুই কী বলছিস! কী সর্বনাশের কথা!
শুভ্ৰ শান্ত স্বরে বলল, খারাপ বাড়ির খুব রূপবতী একটা মেয়ে তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করে। ঐ মেয়েটার কিছুই আমার মনে নেই। শুধু তার গায়ের গন্ধ মনে আছে।
জাহানারা বললেন, এইসব কথা আমাকে তখন বলিস নি কেন?
শুভ্ৰ হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুড়ো ভদ্রলোক কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছিলেন। ঐ বুড়ো মানুষটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করতাম। তাঁর নিষেধ আগ্রাহ্য করার প্রশ্নই উঠে না। মা শোন, তখন আমি ছোট ছিলাম। কিছুই বুঝতাম না। এখনো যে খুব বেশি বুঝি তা না। তবে এখন দুই-এ দুই-এ চার মেলাতে পারি। এখন জানি আমার জন্ম হয়েছিল ঐ ভয়ঙ্কর বাড়িগুলির একটিতে। ঐ রূপবতী মেয়েটি ছিল আমার মা। বুড়ো ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে আমার মার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।