আজ সকাল থেকেই লোড শেডিং। মোতাহার সাহেব পা তুলে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন (গদিওয়ালা চেয়ারে তিনি বসতে পারেন না; তাঁর না-কি সুড়সুড়ি লাগে)। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। মোতাহার সাহেব নাক কুঁচকে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছেন; মোমবাতির শিখা ঠিকমত জ্বলছে না। বাঁকা হয়ে জ্বলছে বলে প্রচুর মোম গলে গলে পড়ছে। অন্যসময় হলে শিখাটা ঠিক করে দিতেন। আজ তা করছেন না, কারণ তাঁর শরীর খুবই খারাপ লাগছে। গায়ে জ্বর নেই, কিন্তু থার্মোমিটার ধরতে পারে না এমন জুরে শরীর কাহিল হয়ে আছে। শরীরের ভেতরে শীত লাগছে। শরীরের বাইরে লাগছে না। বাইরে বরং সামান্য গরম লাগছে। তিনি বিশ্ৰী গন্ধ পাচ্ছেন। যে-কোনো বড় ধরনের অসুখের আগে আগে মোতাহার সাহেব এরকম গন্ধ পান। টাইফয়েড় হবার আগে পেয়েছেন, জণ্ডিস হবার আগে পেয়েছেন। সেই দুবারই তাঁর জীবন সংশয় হয়েছিল।
তিনি টেবিলে লাগানো কলিং বেল কয়েকবার টিপলেন। মঞ্জু ঘরে ঢুকাল না। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে কলিংবেল কাজ করছে না – এটা তার মাথায় নেই! ডাকা-মাত্ৰ মঞ্জুকে না দেখলে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন। তিনি রাগী গলায় ডাকলেন, মঞ্জু, মঞ্জু।
মঞ্জু দরজা টেনে প্ৰায় ঝড়ের মত এসে উপস্থিত হল। মঞ্জুকে তিনি কেন ডেকেছেন মনে করতে পারলেন না। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, মনেও পড়ল না। তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। দুৰ্গন্ধটা আরো কড়া হয়ে নাকে আসছে। কোনো ইদুর কি মরে পড়ে আছে? মঞ্জু করে কী! ভালমত দেখবে না। তিনি মঞ্জুর উপর রাগটা কমানোর চেষ্টা করছেন। কমাতে পারছেন না। রাগটা পুরোপুরি না কমা পর্যন্ত মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না। মনে রাগ নিয়ে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
মঞ্জু।
জ্বে।
পঁচা গন্ধ পাচ্ছিস?
জ্বে না।
আমিতো পাচ্ছি। তুই পাচ্ছিস না কেন? নাক বন্ধ?
মঞ্জু, জবাব দিল না। মাথা নিচু করে রাখল। মোতাহার সাহেব বললেন, চা দে।
মঞ্জু ঘর ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় খুব সাবধানে দরজা বন্ধ করল। দরজা বন্ধের শব্দ মোতাহের সাহেবের অসহ্য লাগে। দরজায় প্যাডের মত লাগানো হয়েছে। তারপরেও দরজা বন্ধ করলে, খুললে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ হয়। সেই শব্দও তাঁর সহ্য হয় না।
পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে মঞ্জু বলল, ম্যানেজার সাহেব কথা বলতে চান। আসতে বলব?
মোতাহার সাহেব মাথা কান্ত করলেন। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ পড়ে আছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। এটা নতুন কিছু না। তিনি প্রায়ই চা চান। তাকে চা দেয়া হয়। পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ সামনে পড়ে থাকে, তিনি ছুঁয়েও দেখেন না।
ম্যানেজার ছালেহ ঘরে ঢুকলেন। চেয়ার টেনে সাবধানে বসলেন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপর। মোটা থলথলে শরীর। বয়স যত বাড়ছে তাঁর শরীর তত বাড়ছে। মোতাহার সাহেব তাঁর এই ম্যানেজারকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। ম্যানেজার শ্রেণীর মানুষ কখনো সৎ হয় না। এই মানুষটা সৎ। ব্যবসা অত্যন্ত ভাল বুঝেন। হাস্যমুখী মানুষ। মুখের কােটাটা এমন যে সব সময় মনে হয়। ভদ্রলোক হাসছেন। মোতাহার সাহেব যেমন কখনোই রাগেন না, ইনি আবার অন্যরকম, চট করে রেগে যান।
মোতাহার সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, ছালেহ কেমন আছ?
জ্বি ভাল।
কোনো খবর আছে?
ম্যানেজারের মুখে হাসি দেখা গেল। আসল হাসি। মুখে লেগে থাকা সাৰ্বক্ষণিক হাসি না।
পনেরো লাখ টাকার চেকটা ক্যাশ হয়েছে। আমিতো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
ক্যাশ হয়েছে?
জ্বি। ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিলেন।
মোতাহারু সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভাল খবর; তুমি অসাধ্য সাধন করেছ।
স্যার আপনার কি শরীর খারাপ?
শরীরটা ভাল লাগছে না।
বাসায় চলে যান।
শরীর যদি ভাল না লাগে, কোনোখানে ভাল লাগবে না।
প্রেসারটা মাপবেন? ডাক্তার সাহেবকে খবর দেই?
মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। ছালেহ উদ্দিন বললেন, এক কাজ করুন, শুয়ে থাকুন, মঞ্জুকে বলি পা টিপে দিক।
আচ্ছা বল।
ছালেহ উঠতে যাচ্ছিলেন, মোতাহার সাহেব বললেন, তুমি বোস। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।
ছালেহ সাথে সাথে বসে পড়লেন। মোতাহার সাহেব জরুরি কথা কিছু বললেন না। আগের মত মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ছালেহ বললেন, ছোট বাবু কি ময়না পাখিটা পছন্দ করেছে?
হুঁ করেছে। খুব পছন্দ করেছে। সে খুবই খুশি।
ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে। মোমবাতি নিভে গেছে। ফ্যান থেকে খট খট শব্দ আসছে। ফ্যানের এই আওয়াজ মোতাহার সাহেবের খুবই অপছন্দ। এসির আওয়াজ তার চেয়েও বেশি অপছন্দ। প্ৰচণ্ড গরমেও এই ঘরে ফ্যান কিংবা এসি চলে না। যদিও নিজের বাড়িতে এসি চলে। সেই শব্দে তার কোনো সমস্যা হয় না। মঞ্জু হাত পাখা দিয়ে তাঁকে হওয়া করে। ঝালর দেয়া বিরাট একটা তালপাখা এই ঘরে ঝুলানো আছে।
ছালেহ বললেন, স্যার ফ্যান বন্ধ করে দেব?
মোতাহার সাহেব বললেন, না থাক।
জরুরি কথা কী বলবেন বলছিলেন।
মোতাহার সাহেব পা নামিয়ে বসলেন। তিনি বসেছিলেন রিভলভিং চেয়ারে। সেই চেয়ার খুব সাবধানে ম্যানেজারের দিকে ঘুরালেন যেন চেয়ারে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ না হয়। তারপরেও শব্দ হল।
ছালেহ।
জ্বি।
শুভ্ৰকে তোমার কেমন ছেলে মনে হয়?
ছালেহ কিছুক্ষণ তাঁর বড় সাহেবের তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আপনার প্রশ্নটা বুঝলাম না। শুভ্ৰ কেমন ছেলে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মালিকের ছেলে বলে না… এই জীবনে আমি অনেক ছেলেপুলে দেখেছি, এরকম দেখি নাই।