উনার সম্পর্কে ভেবে ভেবে আমি কিছু বের করতে পারি না। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়। কেউ যেন তাঁর সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা না পায় এই জন্যেই তিনি অদ্ভুত ব্যবহারগুলি করেন।
তাঁর এখন খুব দুঃসময় যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে আমি তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে দুঃসময়টা তিনি উপভোগ করছেন। যুদ্ধবাজ মানুষ যেমন যুদ্ধ করে মজা পায় তেমন মজা। জটিল কোনো সরল অংক ধীরে ধীরে করার মজা। ধাপে ধাপে অংকটা তিনি করছেন। তিনি জানেন সঠিক উত্তরটা তিনি বের করবেন। এটা জানেন বলেই অংকটা করতে তার ভাল লাগছে। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এক সময় অংকের উত্তর পেয়ে যাবেন— একারণেই কষ্টটা ভাল লাগছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি প্ৰতিশোধ নেবার চেষ্টা করছেন। বাবার ওপর প্ৰতিশোধ, মার ওপর প্রতিশোধ। প্রতিশোধ নেবার ভঙ্গিটা গ্ৰাম্য। তার মত মানুষ এই ভঙ্গিতে প্ৰতিশোধ নেবে তা ভাবা যায় না।
আমি তাঁর কেউ না। তারপরেও আমার খুব ইচ্ছা করে অংকের সমাধানে আমি তাকে সামান্য হলেও সাহায্য করি। জানি তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন নেই, তারপরেও পাশে থাকি। মাঝে মাঝে যখন রাতে তার ঘুম হয় না। তিনি আমাকে ডেকে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। গল্প করেন। তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কোনো গল্প না। অন্য প্রসঙ্গ— ধর্ম-বিজ্ঞান। যার কোনোটাই আমি জানি না। ধর্ম বলতে আমি জানি বাবাকে দেখে যা জানা। আর আমার বিজ্ঞান হল স্কুল কলেজে পড়া বিজ্ঞানের বই। উনি বলতেন ভিন্ন কথা।
শোন বিনু, আমরা এক আল্লাহর কথা বলি না? একে বলে একেশ্বরবাদ। সর্ব প্রথম একেশ্বরবাদ কে প্রচার করেন জান? মিশরের এক ফেরাউন। তাঁর নাম ফারাও ইখনাইন। খুব জোরালোভাবে একেশ্বরবাদী ছিল হিব্রুরা। হিব্রুদের নবী কে বল দেখি।
জানি না।
জানবে না কেন! অবশ্যই জান। হযরত মূসা আলাইহেস সালাম। হযরত দাউদ, হযরত সুলায়মান আলাইহেস সালাম। আমরা মুসলমানরাও তাদেরকে নবী স্বীকার করি। আচ্ছা বল দেখি, এবার কঠিন প্রশ্ন, বল কোন ধর্মে আল্লাহ বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই।
জানি না।
অবশ্যই জান, কেন জানবে না। বৌদ্ধ ধৰ্ম।
আচ্ছা এবার সহজ প্রশ্ন। গৌতম বৌদ্ধ এক পূর্ণিমার রাতে ঘর ছেড়ে বের হয়েছিলেন। কোন পূর্ণিমা?
জানি না।
আচ্ছা এখন বিজ্ঞান বল দেখি-বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে প্রথম কারা ভাগ করতে শেখে।
জানি না।
টাইগ্ৰীস নদীর তীরের শহর আশুর নগরের বিজ্ঞানীরা। এই কাজটা তারা করেন খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে। আশুর নগর অতি সুসভ্য ছিল। এই সভ্যতাকে বলা হয় আশেরীয় সভ্যতা।
শুভ্ৰ মানুষটার এইসব গল্পকে তাঁর মা বলেন জ্ঞানী-গল্প। তিনি তাঁর পুত্রের জ্ঞানী-গল্প খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনেন। আমিও শুনি। গল্পগুলি শুনে উনি কী ভাবেন আমি জানি না। আমি ভাবি কেন তিনি গল্পগুলি করছেন? আমাকে মুগ্ধ করার জন্যে? না, তা হবে না। যে মুগ্ধ হয়েই আছে তাকে মুগ্ধ করার কিছু নেই। তাহলে তার উদ্দেশ্যটা কী?
জ্ঞানের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে তিনি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলেন। জ্ঞানের গল্পের চেয়েও অনেক আগ্রহ নিয়ে আমি এই গল্পগুলি শুনি।
বিনু শোন, ঐ মানুষটাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।
কোন মানুষটা?
ভদ্রলোক মারা গেছেন। বুড়ো একজন মানুষ। আমাকে শুবরু বলে ডাকতেন।
যিনি মারা গেছেন তাঁকে খুঁজে বের করবেন কীভাবে?
ও আচ্ছা, তাইতো! তবে তাঁকে আমি খুঁজছি। তাঁকে মানে তাঁর ফ্যামিলির কাউকে। তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়ে।
কী জন্যে খুঁজছেন?
খুবই তুচ্ছ একটা কারণ। বলতে ইচ্ছা করছে না।
বলতে ইচ্ছা না করলে বলবেন না।
বিনু, তুমি কি লক্ষ করেছ মাঝে মাঝে তুচ্ছ ব্যাপারগুলি বিরাট কিছু হয়ে পড়ে।
না, লক্ষ করি নি।
শূন্য হচ্ছে শূন্য— অতি তুচ্ছ। সেই শূন্য কত বড় যে ব্যাপার তা শুধু জানেন গণিতবিদরা। আচ্ছা বিনু, বল দেখি ভারতবর্ষে একজন বিরাট গণিতজ্ঞ জন্মেছিলেন। পৃথিবীর প্রথম পাঁচ জন গণিতজ্ঞের নাম বলতে হলে তাঁর নাম বলতে হয়। বল উনার নাম কী?
রামানুজন।
বাহ চমৎকার! এই নামটা তুমি জানতে?
জানতাম। আপনি বলেছিলেন।
ও আচ্ছা আমি তাহলে আমার গল্প রিপিট করতে শুরু করেছি। খুবই খারাপ লক্ষণ। বুঝলে বিনু আমার মেন্টাল মেকাপ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। খুব খারাপ সময় আমার সামনে। আমি ভাঙতে শুরু করেছি।
উনি যে ভাঙতে শুরু করেছেন তা আমি দেখতে পাচ্ছি। কিছুক্ষণ আগেই তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি প্রচুর মদ্যপান করে দুদিন পর ঘরে ফিরেছেন। তিনি খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাবছিলেন তিনি স্বাভাবিক আছেন। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। এক পর্যায়ে আমাকে বললেন— বিনু তোমার কী ধারণা আমি মানুষ হিসেবে কেমন?
আমি বললাম, সত্যি জানতে চান?
তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সত্যি জানতে চাই।
আপনি মানুষ হিসেবে নিম্নশ্রেণীর।
তুমি এটা কি আমাকে আহত করবার জন্যে বললে? না-কি তুমি সত্যি বিশ্বাস কর মানুষ হিসেবে আমি নিম্নশ্রেণীর।
আমি আপনাকে আহত করবার জন্যে কখনোই কিছু বলব না। আপনি একটা সত্যি কথা জানতে চাচ্ছিলেন- আমি সত্যি কথাটা বললাম।
তুমি কেন বলছ? মানুষ হিসেবে আমি নিম্নশ্রেণীর— আচ্ছা ঠিক আছে, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তোমার মত অনেকেই আমাকে এখন নিম্নশ্রেণীর ভাবছে। আচ্ছা একটা কাজ কর— তুমি তোমার কনসেপ্টে একজন উচ্চশ্রেণীর মানুষের কথা বল। আমি দেখতে চাচ্ছি। সে আমার চেয়ে কতটা আলাদা।