বাবা আমাকে রেখে চলে গেলেন। বিশাল একটা ঘরে আমার জায়গা হল। সারা রাত এক ফোটা ঘুম হল না। সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি– রাজপুত্রের মত একটা ছেলে হাসিমুখে আমার দিকে আসছে। শুভ্র তাহলে ইনি। এত সুন্দরও হয় মানুষ! তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, বিনু তোমার দেখি সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। ভালই হয়েছে, যাওতো আমার জন্যে দুকাপ চা বানিয়ে আন। একটা কাপে কোনো চিনি থাকবে না, আরেকটা কাপে দুচামচ চিনি থাকবে। পিরিচে করে আলাদা চিনি নিয়ে এসো। এমনভাবে চা বানাবে যেন কারোর ঘুম না ভাঙে। এত সকালে মার ঘুম ভাঙলে ভয়াবহ ব্যাপার হবে। খুবই বদরাগী মহিলা।
আমি শুভ্ৰ নামের মানুষটার কথায় কী যে অবাক হলাম! নিতান্তই অপরিচিত একটা মেয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। অথচ কত স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছেন। শুরুতে তিনি বলতে পারতেন, তোমার নাম বিনু না? তা করেন নি, সরাসরি বিনু নাম দিয়ে কথা আরম্ভ করেছেন। যেন অনেক দিন থেকেই তিনি আমাকে চেনেন। তাঁকে চা বানিয়ে খাওয়াবার দায়িত্ব আমিই এতদিন পালন করে এসেছি।
এ বাড়ির রান্নাঘর কোথায়, চা-চিনি কোথায়— কিছুই জানি না। গ্যাসের চুলা কীভাবে ধরাতে হয় তাও জানি না। তারপরেও আমি ঠিকই দুকাপ চা বানিয়ে তার কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, যে কাপে দুচামচ চিনি সেই কাপটা আমাকে দাও। যে কাপে চিনি নেই সেটা তোমার। তুমি তোমার পরিমাণমত চিনি নাও। তারপর এসো চ খেতে খেতে গল্প করি।
সামান্য দুকাপ চা বানিয়ে আনতে বলার মত তুচ্ছ ঘটনাটাকে মানুষটা কত সুন্দর করে করল। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, তারপরেও কিন্তু উনি না বলা পর্যন্ত বুঝতে পারি নি এক কাপ চা আনা হয়েছে আমার জন্যে।
বিনু তোমার চা ভাল হয়েছে।
আমি কিছু বললাম না। এই ক্ষেত্রে রীতি নিশ্চয়ই থ্যাংক ইউ বলা। আমার মুখ দিয়ে থ্যাংক ইউ বের হল না।
বিনু শোন, চা বানানোর ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। চায়ের পানি ফুটিয়ে চা বানানো হয়। পানি ফুটালে কী হয় জানতো— পানিতে যে ডিজলভড অক্সিজেন এবং অন্যান্য গ্যাস থাকে তা চলে যায়। চা তাতে টেষ্টলেস হয়ে যায়। ফুটন্ত পানি খেতে বিস্বাদ হয় এই কারণে। কাজেই আমার মতে চা বানাতে হবে পানি না ফুটিয়ে। পানির টেম্পারেচার কিছুতেই ৯৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর উঠতে দেয়া যাবে না। বুঝতে পারছি কী বলছি?
জ্বি।
আমার মা তোমাকে বকাঝকা কেমন দিচ্ছে? শোন বিনু, মার কথায় কখনো কিছু মনে করবে না। মার স্বভাব হল বকা দেয়া। কোনো আসমানী ফেরেশতাও যদি আমাদের বাড়িতে থাকতে আসেন, মা তাকে সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা তিনবেলা বকা দেবেন। স্যান্ডেল পায়ে হাঁটলে বলবেন স্যান্ডেল খুলে ফেলতে। খালি পায়ে হাঁটলে বলবেন স্যান্ডেল পরতে।
শুভ্ৰ নামের মানুষটা হাসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর হাসি দেখছি। তার হাসি দেখতে দেখতেই আমার শরীর বিমঝিম করতে লাগল; আমি চোখের সামনে আমার সর্বনাশ দেখতে পেলাম। পরিষ্কার বুঝলাম, আমার পক্ষে কোনোদিনও এই মানুষটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব হবে না। মানুষটা আমাকে সারাজীবনের জন্যে কিনে নিয়েছেন। তিনি যদি এখন আমাকে বলেন, বিনু শোন, পত্রিকায় পড়ি মানুষ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। আমার খুব শখ ঘটনোটা দেখার। তুমি কি কাজটা করবে- আমি দেখব। উনার কথা শেষ হবার আগেই আমি বলব, ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছি। আপনি নিচে গিয়ে দাঁড়ান। তাহলে ভাল দেখতে পাবেন।
আমি এই মানুষটাকে নিয়ে অল্প কদিনে যত ভেবেছি তত ভাবনা কোনো কিছু নিয়েই কখনো ভাবি নি। মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করাই, তারপর অন্য আরেকটা, আবার তৃতীয় কোনো ব্যাখ্যা।
যেমন শুরুতে ব্যাখ্যা করলাম– শুভ্ৰ নামের মানুষটা সরল প্রকৃতির। মনের ভেতর কিছুই রাখেন না। কোনো কিছু লুকাতে হবে এটা তাঁর প্রকৃতির ভেতর নেই, যে কারণে নিজের বদরাগী মা প্রসঙ্গে এত অবলীলায় কথা বলতে পারছেন। মার আড়ালে যে বলছেন তা না, মার সামনেও বলছেন। কেউ তার কথায় আহত হচ্ছে কি-না এটা শুভ্র কখনো ভেবে দেখেন না। শিশুদের সঙ্গে এইখানে তার মিল আছে। শিশুরাও অবিকল এ রকম।
তারপরই মনে হল ব্যাখ্যাটা ঠিক না। তিনি গোপন করেন। অনেক কিছুই গোপন করেন। তার মা আমাকে এক সময় চোর প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন। এই ঘটনা তিনি জানেন। কিন্তু আমাকে তিনি কখনো কিছু বলেন নি। যে কোনো কিছুই গোপন করে না সে এত বড় ঘটনা গোপন করবে না। সে হাসতে হাসতে বলবে, বিনু শোন, মার কী অদ্ভুত ধারণা! তুমি না-কি মার টাকা চুরি করেছি। উনি এই প্ৰসঙ্গটা চেপে গেছেন।
বাচ্চাদের স্বভাব যখন বয়স্ক মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। তখন ধরে নিতে হয়। যে মানুষটা হয় বোকা, আর তা যদি না হয় তাহলে সে ভান করছে। শিশু সাজার চেষ্টা করছে। শুভ্ৰ মানুষটা অবশ্যই বোকা নন, তাহলে তিনি কি ভান করছেন? যদি ভান করেন তাহলে ভানটা করছেন কেন? আশেপাশের মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্যে? আশেপাশের মানুষকে কে বিভ্রান্ত করতে চায়? যে নিজে বিভ্রান্ত সে করবে। শুভ্ৰ বিভ্রান্ত না। নিজের ওপর, নিজের বিচার বুদ্ধির ওপর তাঁর আস্থা সীমাহীন। তাহলে তিনি কেন বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন? কোনো স্বাৰ্থ সিদ্ধির জন্যে না মজা করার জন্যে?