গল্প শেষ করে শুভ্ৰ হাসছে। কিছুতেই তার হাসি থামছে না। বিনু তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনো হাসি নেই। শুভ্র বলল, শব্দ করে হাসায় একটা উপকার হয়েছে- শরীর খারাপ ভাবটা সামান্য কমেছে।
আপনি রাতে খাবেন না? না। ক্ষিধে নেই।
চাচি আপনার জন্যে অসুস্থ শরীরে রান্না করেছেন। ক্ষিধা না থাকলেও একটু বসুন। ভাত নাড়াচাড়া করুন। উনি আপনার সঙ্গে খাবেন বলে রাতে খান নি।
ভাত নড়াচাড়া করতে ইচ্ছা করছে না। শুয়ে আছি, শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। আচ্ছা বিনু, তুমি ভালো করে আমার দিকে তাকাও তো। আমার যে প্রচণ্ড মন খারাপ। আমাকে দেখে কি বোঝা যাচ্ছে?
না বোঝা যাচ্ছে না।
আমার খুবই মন খারাপ।
কেন?
তেমন কোনো কারণ নেই। শোন বিনু, মন ভালো হবার জন্যে কারণ লাগে। কিন্তু মন খারাপ হবার জন্য কোনো কারণ লাগে না। মাঝে মধ্যেই দেখবে সব ঠিকঠাক চলছে, সুন্দর সকাল, ঝকঝকে রোদ উঠেছে, নীল ঝলমলে আকাশ; তারপরেও এ মন খারাপ হয়ে গেল। তোমার এরকম কখনো হয় না?
আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে।
সাধারণ মেয়েদের মন খারাপ হয় না?
সাধারণ মেয়েদের মন খারাপ হয় খুবই সাধারণ কারণে।
উদাহরণ দিয়ে বুঝাওতো।
একটা সাধারণ মেয়ে যদি হঠাৎ খবর পায়- তার বাবা মারা গেছেন। তখন তার মন খারাপ হবে।
শুভ্ৰ বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, বিনু তোমার বাবা মারা গেছেন?
বিনু জবাব দিল না।
আমি কী করছি
আমি কী করছি? আমি কেন এই বাড়িতে পড়ে আছি? এদের সঙ্গে আমার যোগটা কোথায়? জাহানারা নামের একজন মহিলা অসুস্থ, পাগলের মত আচরণ করছেন— শুধুমাত্র এই কারণে আমি থেকে গেছি। এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক আমি নিজেতো করছি না। আমার বাবা মারা গেছেন। মার এখন দিশেহারা অবস্থা। অথচ আমি দিব্যি থেকে গেলাম। সন্ধ্যাবোলা রাণীর মা চা দিয়ে গেল। আমি স্বাভাবিকভাবেই চা খেলাম। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, রাতে কী রান্না হবে? আমি তাও বললাম; রাতে শুভ্ৰ নামের মানুষটার গল্প শুনলাম। বৃদ্ধার ভালুকা যাবার গল্প। আমি উঠে যেতে চাচ্ছিলাম, শুভ্ৰ নামের মানুষটা হাত ধরে আমাকে বসাল। আমার তাতে কোনোরকম অস্বস্তি বোধ হল না, সংকোচ বোধ হল না। মনে হল এটাইতো স্বাভাবিক।
আমি কি আশা করে আছি। এই মানুষটার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? না, আমি কোনো কিছুই আশা করে নেই। যে পরিবারে আমার জন্ম, যে পরিবেশে আমি বড় হয়েছি সেখানে কেউ কখনো আশা করে না। স্বপ্ন দেখে না। বেঁচে থাকার চেষ্টাতেই আমরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি— আশাটা করব কখন? তবে আমার বাবা আশা করতেন। তিনি স্বপ্ন দেখার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন। এসএসসি’র রেজাল্ট বের হবার পরের এক মাস যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে তাকেই বলেছেন, আমার মেয়ে একটা বিরাট কিছু হবে। তার জীবনী লেখা হবে। বেগম রোকেয়ার জীবনী যেমন লোকে পাঠ করেছে, আমার মেয়েরটাও পাঠ করবে ইনশাল্লাহ।
সত্যি সত্যি যদি কখনো আমার জীবনী লেখা হয়। সেখানে নিশ্চয়ই আমার ছেলেবেলার কথা থাকবে। সেখানে কি উল্লেখ থাকবে অতি শৈশবে হাটবারে আমি এক হাটে যেতাম? সঙ্গে থাকতো হাঁস-মুরগির ডিম, পাকা পেঁপে। হাটের এক কোণায় পেঁপে এবং ডিম নিয়ে বসে থাকতাম খরিদ্দারের আশায়।
আমি এখন সুন্দর একটা ঘরে শুয়ে আছি। ঘরে বাতি জ্বলছে। জানোলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। ইচ্ছা করলেই আমি চাঁদ দেখতে পারি। ইচ্ছা করছে না। নিজেকে কেমন যেন অশুচি এবং নোংরা মনে হচ্ছে; মনে হচ্ছে। আমি যেন কোনো দুষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এ বাড়িতে বাস করছি। পরিকল্পনার শেষ না দেখে আমি নড়তে পারছি না। অথচ আমার কোনোই পরিকল্পনা নেই। আমার কোনো স্বপ্ন নেই। আমার কিছুই নেই।
বাবা আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁর কত বড় বড় কথা— বিনু দেখবি তোকে তারা কত আদর করে। খানদানী ফ্যামিলি- এদের ব্যাপারই আলাদা। বড় মানুষদের মনও বড় হয়। যে গর্তে বাস করে তার মনটা হয়। গর্তের মত, যে রাজপ্রাসাদে বাস করে তার মন হয় রাজপ্ৰসাদের মত বড়। আমি বাবার সঙ্গে তর্ক করতে পারতাম। বাবাকে উদাহরণ দিয়ে বলতে পারতাম পৃথিবীর সব বড় মানুষরা অতি ক্ষুদ্র ঘরে জনেছিলেন। তর্ক করি নি। তর্ক করতে আমার ভাল লাগে না।
এই বাড়িতে এসে প্রথম দেখা হল বাড়ির কর্ত্রী জাহানারা নামের মহিলার সঙ্গে। বাবা বললেন, মাগো সালাম কর— তোমার চাচি। পায়ে হাত দিয়ে দোয়া নাও।
মহিলা কঠিন গলায় বললেন, পায়ে হাত দিও না। জার্নি করে এসেছি। শরীর নোংরা। তাছাড়া কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভাল লাগে না।
মহিলা এমনভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন যেন আমি সত্যি সত্যি নর্দমার ংরা মেখে উঠে এসেছি। আমার সমস্ত শরীর থেকে বিকট দুৰ্গন্ধ আসছে। মহিলা তাঁর নোকও খানিকটা কুঁচকে আছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন- এই মেয়ে থাকবে কোথায়? আমরাতো দোতলায় কাউকে রাখি না। শুত্র পড়াশোনা করে অপরিচিত কাউকে দেখলে বিরক্ত হয়।
বাবা বোকার মত বললেন, অপরিচয় থাকবে না ভাবি সাহেবা। পরিচয় হবে। বিনু তার ছোটবোন। দুনিয়ার কোনো ভাইকে দেখেছেন বোনের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হা হা হা।
চাচি বললেন, ভাই-বোন পাতাতে হবে না। কয়েকটা দিন থাকার দরকার— থাকবে। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, এই বন্দোবস্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না। পরের বার যখন ঢাকায় আসবেন— দয়া করে এই বাড়িতে আসবেন না। আর শোন মেয়ে, বাড়িতে কখনো স্যান্ডেল ফট ফট করে হাঁটবে না। খালি পায়ে হাঁটবে। স্যান্ডেলের ফটফট শব্দ আমার সহ্য হয় না।