শুভ্রর বাবা বললেন, একটা কাজ করতে পারবে? গরম ভাত রোধে দিতে পারবে? ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি ঢেলে দিয়ে খাব।
বিনু বলল, আপনি এতো কথা বলছেন কেন? আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। আমি মাথায় পানি ঢালব।
কাউকে বাজারে পাঠাও সজনে আনুক। আর খোঁজখবর করে দেখা শুভ্ৰকে পাও কি-না। আজ আমরা তিনজন এক সঙ্গে খাব। একটা ইলিশ মাছ আনতে দিওতো। ইলিশ মাছের ভাজা শুভ্রর খুবই পছন্দ। একবার কী হয়েছে মা শোনশুভ্র তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। সে স্কুলে টিফিন নিয়ে যায়। আমাকে বলল— আজ ইলিশ মাছ ভাজা টিফিন নিয়ে যাব। আমি হোসে বাঁচি না। সে ইলিশ মাছ ভজা না নিয়ে স্কুলে যাবে না। শেষে ইলিশ মাছ ভেজে টিফিন বক্সে দিয়ে রক্ষা। অসম্ভব জেদি ছেলে। অথচ তাকে দেখে মনে হয়। পৃথিবীর কিছুই বুঝে না।
চাচি, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুনতো।
শুয়েইতো আছি।
কথা বলবেন না।
আচ্ছা যাও বলব না, শুধু শুভ্ৰর আরেকটা গল্প বলি– শুভ্র তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর বাবা শখ করে একটা জিপারওয়ালা প্যান্ট এনে দিয়েছে। জিপার টেনে বন্ধ করার সময় ছেলের জিনিস জিপারের সঙ্গে লেগে গেলো। জিনিস মানে বুঝতে পারছ তো? হিহিহি…।
জাহানারা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন। হাসতে হাসতেই গল্পের বাকি অংশ জড়ানো গলায় বলে যাচ্ছেন- বিনু কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসির মাঝখানে তিনি কাঁদতেও শুরু করলেন। বিনু ডাক্তার আনতে পাঠাল।
শুভ্ৰ বাড়ি ফিরুল রাত এগারোটায়। তার মুখ থেকে ভকভক করে গন্ধ আসছে। পা সামান্য চলছে। চোখ সামান্য লাল। কিন্তু কথাবার্তা খুবই পরিষ্কার।
বিনু দরজা খুলে দিল। শুভ্র বলল, কেমন আছ বিনু?
বিনু বলল, ভাল।
মা কি ঘুমুচ্ছে?
হ্যাঁ।
বিনু শোন, তুমিও শুয়ে পড়। আমি রাতে কিছু খাব না।
আপনার কি শরীর খারাপ?
না, আমার শরীর খারাপ না। মাতাল হলে কেমন লাগে এটা পরীক্ষার জন্যে প্রচুর মদ্যপান করেছি। মাতাল হতে পারি নি।
কোনো মাতাল কি বুঝতে পারে সে মাতাল হয়েছে?
তা বুঝতে পারে না। তবে আমি বুঝতে পারব। আমার শরীর টলছে, কোনোদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছি না। কিন্তু আমার লজিক পরিষ্কার। এ থেকেই বুঝছি আমি মাতাল হইনি। মনে মনে আমি বুলিয়ান এলজেব্রার জটিল একটা সলিউশনও করলাম। কোনো সমস্যা হয় নি।
আপনার কাছে লজিক পরিষ্কার মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে হয়তো লজিক পরিষ্কার না। আপনার শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
হু। প্রচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে। কিন্তু বমি হচ্ছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেছি।
লবণ-পানি এনে দেব? লবণ-পানি মুখে দিয়ে চেষ্টা করবেন?
আচ্ছা এনে দাও।
আপনি কি একণ একা বাথরুমে যেতে পারবেন? না। আমি ধরে ধরে নিয়ে যাবো।
তুমি ধরে ধরে নিয়ে যাও।
বিনু এসে শুভ্ৰকে ধরল। শুভ্র বলল, আমাকে বাথরুমে নেবার দরকার নেই। তুমি আমাকে বিছানায় শুইয়ে দাও।
বিনু শুভ্ৰকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে চেষ্টা করল। শুভ্ৰ হাত ধরে তাকে আটকে দিল। অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?
আপনার জন্যে লবণ-পানি নিয়ে আসছি।
লবণ-পানি লাগবে না। তুমি এখান থেকে নড়বে না।
মাথায় পানি ঢেলে দেব?
আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ, খুবই খারাপ লাগছে! কী মনে হচ্ছে জান? মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মারা যাবো। মৃত্যুর আগে মানুষের প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমারাও কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
কথা বলুন। আমি শুনছি।
মদ খেলে কী হয় জান বিনু? মদ খাবার পর যারা প্রিয় মানুষ তাদেরকে অসম্ভব প্রিয় মনে হয়। সুন্দর মনে হয়। যারা অপ্রিয় মানুষ তাদেরকে অনেক বেশি অপ্রিয় মনে হয়। অসুন্দর মনে হয়। যেমন তুমি। তোমাকে যে আজ কী সুন্দর লাগছে সেটা শুধু আমিই জানি।
একদিন মদ খেয়েই বুঝে গেলেন, মদ খেলে প্রিয় মানুষকে সুন্দর লাগে?
এটা আমার থিয়োরি না। আখলাক সাহেবের থিয়োরি। তবে আমার ধারণা থিয়োরি ঠিক আছে। তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।
আপনি কি দয়া করে চোখ বন্ধ করে ঘুমুবার চেষ্টা করবেন?
না, চেষ্টা করব না। আমি জেগে থাকব; সারারাত তোমার সঙ্গে গল্প করব। বিনু একটা হাসির গল্প শুনবে? গল্পটা আমাকে আসমানী বলেছে। সে মজার মজার গল্প জানে। গম্ভীর মুখে গল্প বলে। গল্প শুনে হাসতে হাসতে প্ৰাণ যাবার মতো হয়। আসমানীর গল্পটা তোমাকে বলব?
বলুন।
এক বৃদ্ধা মহিলা ময়মনসিংহ থেকে বাসে উঠেছে। সে বাসে উঠেই কন্ডাক্টারকে বলল, বাবা, ভালুকা আসলে আমারে বলবা। কন্ডাক্টার বলল, জ্বি আচ্ছা বুড়ি মা, বলব। বাস চলতে শুরু করল। বুড়ি কিছুক্ষণ পর পর জানতে চায়- ভালুকা এসেছে? কন্ডাক্টর বলল, কেন বিরক্ত করেন? এর মধ্যে সতেরোবার জিজ্ঞেস করেছেন। ভালুকা আসুক বলব। এখন বুড়ি মা আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করে থাকেন। পানি খান। বুড়ি চুপ করে থাকে না। একটুপর জিজ্ঞেস করে— ভালুকা আসছে? ও বাবা ভালুকা আসছে? বাসের সবাই মহা বিরক্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ভালুক যখন এসেছে করোরই আর কিছু মনে নাই। বাস বুড়িকে নিয়ে ভালুকা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল। যখন খেয়াল হল তখন কন্ডাক্টর জিবে কামড় দিল। বাসের সব যাত্রী কন্ডাক্টারকে গালাগালি করতে লাগলো। ড্রাইভার বাস ঘুরিয়ে ভালুকার দিকে রওনা দিল। এক ঘণ্টা পরে ভালুকা এসে পৌঁছল। কন্ডাক্টার লজ্জিত গলায় বলল, বুড়ি মা নামেন, ভালুক এসেছে। বুড়ি এই শুনে বিরক্ত মুখে বলল, নামব কী জন্যে? ওষুধ খাবো। ডাক্তার সাব আমারে একটা ট্যাবলেট ময়মনসিংহে খাওয়াইয়া দিয়া বলেছে আরেকটা ট্যাবলেট ভালুকায় খাইতে। এখন আপনেরা এক গেলাস পানি দেন।