আফামনি কাঁদতেছে।
আফামনি আবার কী? বিনু আফামনি হল কবে? তুমি যেমন বিনুও তেমন। বিনুর থাকার জায়গা নেই, থাকতে দিয়েছি। সে কাঁদছে কেন?
উনার পিতা ইন্তেকাল করেছেন। ভাই খবর নিয়া আসছে। এই জন্যে কাঁদতেছেন।
বিনুর বাবা মারা গেছে?
জ্বি।
কবে মারা গেছে?
বুধবারে। সেই দিন উনার শইলটা ভাল ছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে চাঁদর গায়ে দিয়া ঘুমাইতেছিলেন। ঘুমের মধ্যে ইন্তেকাল হয়েছে, কেউ বুঝতে পারে নাই।
তুমি এত কথা জানলে কী করে?
উনার ভাই বলেছেন।
তার সঙ্গে তোমার এত কথা বলার দরকার কী? পুরুষ মানুষ দেখলেই কথা না বলে থাকতে পার না? যাও বিনুকে ডেকে নিয়ে এসো।
আফামনি দরজা বন কইরা কাঁদতেছে। ডাকলে শুনবে না।
তুমি গিয়ে বল আমি ডাকছি। আমার কথা বললেই শুনবে।
জাহানারা অপেক্ষা করছেন। বিনু আসছে না। আশ্চর্য! মেয়েটা এত বেয়াদব? এতো দেখি ম্যানেজারের চেয়েও বেয়াদব। তিনি সব সহ্য করবেন, বেয়াদবি সহ্য করবেন না। মানুষ মারা যাবে, কেউ অনন্তকাল বাঁচবে না, তাই বলে বেয়াদবি করতে হবে? জাহানারা বিনুর সীমাহীন বেয়াদবির কথা ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন নৌকায় করে তিনি কোথায় যেন যাচ্ছেন। তাঁর কোলে শুভ্ৰ। সে দুধের শিশু, কিন্তু তার চোখে চশমা। তিনি শুভ্রর বাবার সঙ্গে রাগীরাগি করছেন— বাচ্চাদের কত সুন্দর সুন্দর চশমা পাওয়া যায়, এইসব না কিনে বুড়ো মানুষদের মত কী চশমা কিনছ! সারা মুখ ঢেকে গেছে এত বড় চশমা। শুভ্রর বাবা বলছেন- হ্যাঁ চশমাটা বড়ই হয়েছে। এই বলতে বলতে তিনি নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়লেন। জাহানারা বললেন, তুমি করুছ কী ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে নদীতে পড়ে যাবে তো! আমি সাঁতার জানি আমি তোমাকে তুলতে পারব। কিন্তু আমার কোলে শুভ্ৰ। আমি তাকে নিয়ে কীভাবে তোমাকে তুলিব? শুভ্রর বাবা বললেন- আমি পড়ব না। বলতেই নৌকা কাত হল। শুভ্ৰর বাবা গড়িয়ে পানিতে পড়ে গেলেন। চারদিকে খুব হৈচৈ হচ্ছে। এই হৈচৈ-এ জাহানারার ঘুম ভাঙিল। তিনি তাকিয়ে দেখেন তাঁর বিছানার পাশে বিনু দাঁড়িয়ে আছে। বিনুর হাতে সুটকেস। জাহানারা বললেন, তুমি কোথায় যাও?
বিনু বলল, দেশের বাড়িতে। চাচি, আমার বাবা মারা গেছেন।
জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, আমাকে এত বড় বিপদে ফেলে তুমি চলে যাবার কথা ভাবতে পারলে? তুমি কেমন মেয়ে বল দেখি! তোমার চোখে লউ নাই? দুই রাত ধরে আমার ছেলের খোঁজ নাই। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি, আমার হুঁশ জ্ঞান নাই। কী বলতে কী বলি তার ঠিক নাই, আর তুমি সুটকেস হাতে রওনা দিয়ে দিলে?
বিনু ক্ষীণ গলায় বলল, চাচি, আমার বাবা বুধবারে মারা গেছেন।
জাহানারা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বুধবারে তোমার বাবা মারা গেছেন তার আমি কী করব। তোমার বাবার কপালে লেখা ছিল বুধবারে মৃত্যু। কপালে যদি বুধবারে মৃত্যু লেখা থাকে তাহলে বুধবারেই মৃত্যু হবে। সোমবারে হবে না। আজ শুক্রবার। তোমার বাবাকে কবর দিয়ে দিয়েছে! তুমি গিয়ে তোমার বাবার ডেড বডি দেখবে তার জন্যে তাকে তোমার মা নিশ্চয়ই আচার বানিয়ে রেখে দেয়। নাই। আমি যদি এখন মারা যাই তুমি বল কে আমাকে দেখবে? রাণীর মা দেখবে? কার হাতে তুমি আমাকে রেখে যাচ্ছ?
বিনু বলল, চাঁচি, আপনি একটা জিনিস বুঝতে পারছেন না—
জাহানারা বিনুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না তা ঠিক। আমার জায়গায় তুমি হলে দোতলা থেকে লাফ দিতে। বিনু শোন, আজ যদি এই অবস্থায় আমাকে রেখে তুমি চলে যাও তাহলে এমন অভিশাপ দিব যে তোমার জীবন কাটবে বেশ্যাখানায়, দুনিয়ারী-পুরুষ মানুষের সামনে গায়ের কাপড় খুলতে হবে। তুমি গায়ের কাপড় খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে, পুরুষ মানুষ তোমাকে দেখে দরদাম ঠিক করবে। তুমি বলবে দুইশ টাকা ওরা বলবে পঞ্চাশ…
চাচি, আপনি কী বলছেন এইসব?
যা ঘটবে তাই বললাম। তারপর কী হবে শোন— দুইশ এবং পঞ্চাশের মাঝামাঝি রফা হবে…।
চাচি, আমি আপনার পায়ে পড়ি।
জাহানারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমাকে আমার পায়ে পড়তে হবে না। আমি তোমার পায়ে পড়ি। তুমি আমার সংসারটা ঠিক করে দিয়ে যাও। আমার মাথা পুরোপুরি গেছে! আমি এখন কোনো কিছুই চিন্তা করতে পারি না। মাগো শোন, তুমি কাছে আসা। আমি তোমার পায়ে হাত দিব। পায়ে হাত দেবার পরেতো তুমি আর যাবে না?
জাহানারা চিৎকার করে কাদতে শুরু করেছেন। তিনি খাটের কোণায় নিজের মাথা ঠুকতে চেষ্টা করলেন। বিনু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে বলল, চাচি আপনি শান্ত হোন। আপনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না। জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে সহজ গলায় বললেন- বিনু কাউকে কাঁচাবাজারে পাঠাও তো। সজনে পাওয়া যায় কি-না দেখ। সজনের চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি নিজে রাধব। তোমরা যেভাবে সজনের চচ্চড়ি কর আমি কিন্তু সে রকম করি না। আমার মার কাছ থেকে শিখেছি— শুধু কাঁচা মরিচ। আর সামান্য আদা। একবার খেলে কোনো দিন ভুলবে না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। শুভ্রর বাবার খুব পছন্দের তরকারি। একবার কী হয়েছে শোনা— শুভ্রর বাবা ঘুমুচ্ছিল। রাত বাজে তিনটা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে সে উঠে বসল। আমাকে ডেকে তুলে বলল— শুভ্রর মা, বড় ক্ষিধা লেগেছে। ঘরে কি পাতে খাওয়ার ঘি আছে? আমি বললাম, আছে।