তুমি যাও সে সব জায়গায়?
যাব না কেন? টাকা দিলেই আমি যাব। বাগান বাড়িতে যাবার জন্যে আমরা অনেক বেশি টাকা পাই। একেক রাতের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। আপনার কাছে যদি পাঁচ হাজার টাকা থাকে তাহলে আপনি আমাকে কোনো বাগান বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন।
আমার তো কোনো বাগান বাড়ি নেই।
পরিচিত এমন কেউ নাই যার বাগান বাড়ি আছে?
না।
আমি একটা বাগানবাড়ি খুব ভাল করে চিনি। আপনাকে নিয়ে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। দারোয়ান হাসিমুখে ঘর খুলে দেবে। যাবেন?
শুভ্ৰ জবাব দিল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আসমানী বলল, আরেকটা পান খান। দানে দানে তিন দান। যে-কোনো জিনিস তিনবার করতে হয়। বিয়ের সময় যে কবুল বলে- একবার কিন্তু বলে না। তিনবার বলে। দেই আরেকটা পান?
দাও।
শুভ্ৰ পান মুখে দিল। তাকে হঠাৎ খুব অস্থির মনে হল। যেন সে খুবই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। সে চোখ থেকে চশমা খুলে আবার চোখে দিল। জানালার কাচ নামিয়ে আবারও কাচ উঠিয়ে দিল।
আসমানী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
শুভ্ৰ বলল, না।
আপনার কপাল ঘামছে। দেখি কাছে আসুন তো, আমি কপালটা মুছে দেই।
শুভ্ৰ নড়ল না। যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে রইল। আসমানী নিজেই এগিয়ে এসে গায়ের ওড়না দিয়ে শুভ্রর কপালের ঘাম মুছিয়ে দিল। শুভ্ৰ অস্পষ্ট গলায় বলল, আসমানী তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি।
আসমানী বলল, বলুন। কথা বলুন।
শুভ্ৰ এক দৃষ্টিতে আসমানীর দিকে তাকিয়ে আছে। আসমানীর ঠোঁটের কোণায় অস্পষ্ট হাসি। সে শুভ্রর চোখের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে তাকিয়ে আছে, আবার তাকিয়েও নেই।
চুপ কইরা আছেন কেন? বলেন কী বলবেন।
কীভাবে বলব গুছাতে পারছি না।
এই রকম হয়। অনেক কথা আছে গলা পর্যন্ত আসে। কিন্তু গলা দিয়া বাইর হয় না। তারও ওষুধ আছে।
কী অষুধ?
তখন মাল খাইতে হয়। মাল কী জানেন–মদ। মদরে লোকে মাল বলে আবার মেয়ে মানুষরেও বলে মাল। চলেন যাই কোনোখানে গিয়া বসি। আপনে মাল খান। তারপরে নিশ্চিন্তে কথা বলেন।
আসমানী তোমার সঙ্গে আমি কেন ঘুরছি জান?
না জানি না।
তোমার মনে এ ধরনের কোনো চিন্তা আসেনিতো যে আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি। ব্যাপারটা সে রকম না।
ব্যাপার তা হইলে কী?
আমি তোমাদের কষ্টটা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। কারো খুব কাছাকাছি না গেলে কষ্ট বোঝা যায় না। আমি কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছি।
কষ্ট বুঝতে পারছেন?
মনে হয় কিছুটা পেরেছি।
ছোট সাহেব, আপনেরে একটা কথা বলি মন দিয়া শুনেন। যারা পয়সা দিয়া আমরার কাছে আসে আপনে তারার চেয়েও অনেক খারাপ।
এটা কেন বলছ?
জানি না কেন বললাম। নেন আরেকটা পান খান।
শুভ্ৰ হাত বাড়িয়ে পান নিল। আসমানী হাসিমুখে জানোলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাইরের দৃশ্য মনে হয় তার খুব ভাল লাগছে। তারও মুখ ভর্তি পান। জানালা দিয়ে মাথা বের করে পানের পিক ফেলতে গিয়ে সে তার সালোয়ার মাখামাখি করে ফেলল। এতে মনে হয় তার আনন্দ আরো বাড়ল। সে শুভ্ৰর দিকে তাকিয়ে বলল- ছোট সাহেব, আপনে একটা কাজ করেন। আমার হাত ধইরা বসেন। হাত ধইরা বসলে— আমরার কষ্ট আরো তাড়াতাড়ি বুঝবেন। হিহিহিহি।
আসমানী হাসছে। তার হাসি থামছেই না। রেকর্ড করা হাসির সঙ্গে এই হাসি মিল খাচ্ছে না।
বিনুর বাবা মারা গেছেন
বিনুর বাবা মারা গেছেন। মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছে বিনুর চাচাতো ভাই ইয়াকুব। ঢাকা শহরে সে এই প্রথম এসেছে। ঠিকানা লেখা কাগজ সঙ্গে ছিল, তারপরেও তার পুরো দেড় দিন লাগল বিনুকে খুঁজে বের করতে। বিনুর বাবা মারা গেছেন বুধবার দুপুরে, বিনু খবর পেল শুক্রবার সকালে।
মৃত্যু-সংবাদ দিয়েই ইয়াকুব প্রথম যে কথাটা বলল, গত রাইত থাইক্যা না খাওয়া। ভাত খাওনের জোগাড় আছে?
বিনু ভাই-এর জন্যে ভাত খাবার জোগাড় করতে গেল। সে কাঁদল না, চিৎকার করে শোকের কোনো প্ৰকাশ দেখাল না। ইয়াকুব তাতে খুব স্বস্তি বোধ করল। বিনু চিৎকার হৈচৈ শুরু করলে সমস্যা হত। কে তার ভাতের জোগাড় করত! ক্ষিধেয় তার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে।
জাহানারা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। জানালার ওপাশ দিয়ে বিনুকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, দোতলায় কে এসেছে?
বিনু শান্ত গলায় বলল, আমার চাচাতো ভাই।
তার নাম কী?
ইয়াকুব।
জানোলা দিয়ে কথা বলছি কেন বেয়াদবের মত? ঘরে ঢুকে প্রশ্নের জবাব দাও। বাবা-মা আদব কায়দা শিখায় নাই?
বিনু ঘরে ঢুকল। জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, তুমি কোন সাহসে তোমার ভাইকে দোতলায় আনলে? এই সাহসের মানে কী? তুমি জান না। দোতলায় ওঠা নিষেধ? এক্ষুণি একতলায় পাঠাও!
জ্বি পাঠাচ্ছি।
ইয়াকুব চায় কী?
কিছু চায় না।
তুমি যেভাবে কাজ কর্ম করছ তাতে মনে হয় এই ঘর বাড়ি সবই তোমার। এ রকম মনে করার মত কিছু ঘটে নি। এ বাড়ির কাজের মেয়ে রাণীর মা তোমার চে উপরে আছে। রাণীর মা কাজ করে খায়। তুমি পরের উপর খাও। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
ভাই এসেছে খুব ভাল কথা, এখন ভাই-এর হাত ধরে যেখানকার জিনিস দেখানে চলে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
আজই যাবে।
জ্বি আজই যাব। দুপুরে চলে যাব।
যাবার আগে সুটকেস খুলে দেখিয়ে যাবে। আমার এখন শরীর ভাল না। কোনো দিকে নজর দিতে পারি না। কোনো জিনিস সুটকেসে ভরে নিয়ে গেলে বুঝতে পারব না।
বিনু সামনে থেকে সরে গেছে। কিন্তু জাহানারার মনে হচ্ছে বিনু এখনো সামনে দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে আরো অপমান করতে হচ্ছে। তার নিজের শরীর জ্বালা করছে। মেয়েটাকে কুৎসিত কিছু গালি দিতে পারলে জুলুনি হয়ত কমত। কুৎসিত গালি তিনি জানেন। বাড়ির পেছনে বস্তির পানির কল। পানি নিতে এসে এরা যে সব গালগালি করে তিনি শোবার ঘর থেকে শুনতে পান। এইসব গালাগালির মধ্যে সবচে ভদ্র গালি হল— খানকি মাগি। বিনুকে ডেকে খানকি মাগি গালি দিলে কেমন হয়? মেয়েটা এই গালি শুনে কী করবে? অনেকক্ষণ নিশ্চয়ই হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। জাহানারা কল্পনায় বিনুর বিস্মিত মুখ পরিষ্কার দেখলেন। তার হাসি পেয়ে গেল। হাসি চাপতে গেলেন, সেই হাসি আরো বাড়ল।