বিনু চলে গেল। জাহানারা আবারো আকাশের দিকে তাকালেন। দিন এমন অন্ধকার করেছে যে ঘরে বাতি জ্বালাবার সময় হয়ে গেছে। কোনো কিছুই পরিষ্কার চোখে পড়ছে না। ম্যানেজারকে এ ঘরে ডেকে আনবার পর ঘরের সব কটা বাতি জ্বেলে দিতে হবে। কথা বলার সময় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে না থাকলে তাঁর ভাল লাগে না। মানুষ। শুধু মুখে কথা বলে না। সে তার সমস্ত শরীর দিয়ে কথা বলে। মানুষের সব কথা পুরোপুরি বুঝতে হলে শুধু কথা শুনলেই হয় না- কথা দেখতেও হয়।
চাচি, পানি আর চা এনেছি।
জাহানারা পানির গ্লাস নিয়ে মাত্র দুচুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিলেন। বিনু চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। জাহানারা বললেন, চা তোমার জন্যে। তুমি চায়ের কম্প হাতে আমার সামনে বোস। চা খেতে খেতে গল্প কর।
বিনু বসল। তাকে দেখে বোঝার কোনোই উপায় নেই সে অবাক হয়েছে নাকি বিস্মিত হয়েছে।
জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, শুভ্রর বাবার একটা গল্প তোমাকে বলি শোন। আমাদের বিয়ের দু বছর পরের কথা। শ্রাবণ মাস। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ একদিন শুভ্রর বাবা বলল, বেড়াতে যাবে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, যাব। কোথায়?
শুভ্রর বাবা বললেন, চল কাছেই কোথাও যাই। সমুদ্র দেখেছি কখনো?
আমি বললাম, না।
শুভ্রর বাবা বললেন, চল সমুদ্র দেখে আসি। সমুদ্র আমি নিজেও দেখি নাই।
আমার উৎসাহের কোনো সীমা রইল না। ব্যাগ গোছালাম, নতুন শাড়ি কিনলাম। উত্তেজনায় রাতে ঘুমাতে পারি না। তখন বয়স ছিল কম। আগ্ৰহ উত্তেজনার কোনো সীমা ছিল না। শুভ্রর বাবা রাতের ট্রেনের দুটা ফার্স্টক্লাসের টিকিট এনে দিলেন। সেই টিকিট আমি আমার ব্যাগে খুব সাবধানে রেখে দিলাম। যাতে হারিয়ে না যায়।
শেষ পর্যন্ত আপনাদের যাওয়া হয় নি?
না। যে রাতে যাব সে রাতে সন্ধ্যার সময় শুভ্ৰর বাবা অফিস থেকে ফিরে বলল, রাতের ট্রেনে যাওয়া ঠিক না। প্রায়ই ডাকাতি হয়। দিনের ট্রেনে যাওয়া হবে। সেই দিনের ট্রেন আর আসে নি।
বিনু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। জাহানারা বললেন, ঘটনোটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। গত পরশু ট্রাংক গুছাতে গিয়ে হঠাৎ টিকিট দুটা খুঁজে পেলাম। তখন মনে পড়ল। তোমার চা খাওয়া কি হয়েছে?
জ্বি।
এখন ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে এসো। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় তুমি থাকবে না। ওকে শুধু পাঠিয়ে দেবে।
জ্বি আচ্ছা।
আড়াল থেকেও কিছু শুনবার চেষ্টা করবে না। আড়াল থেকে কথা শোনার তোমার একটা অভ্যাস আছে। এই অভ্যাসের কথা অন্য কেউ না জানলেও আমি জানি।
বিনু কিছু না বলে ঘর থেকে বের হল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যানেজার ঢুকল। জাহানারা ম্যানেজারের নাম মনে করতে চেষ্টা করলেন। একটু আগেই বিনু নামটা বলেছে। এখন আর মনে আসছে না। ম্যানেজারকে ম্যানেজার না বলে নাম ধরে ডাকা উচিত। নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে নামটা শুরু হয়েছে মা দিয়ে। মা দিয়ে শুরু অসংখ্য নাম আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার একটা নাম মনে পড়ছে না। শুধু মনে আসছে মামুন। মামুন তার ছোট ভাই-এর নাম। এই ভাইটা ছ বছর বয়সে পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যায়। ম্যানেজারের মত একটা ফালতু লোকের নাম মনে করতে গিয়ে তাঁর ভাইটার নাম মনে পড়ছে। ছিঃ! কী ঘিন্নার কথা।
জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে না। বোস। চেয়ারটায় বোস।
ম্যানেজার বসল। জাহানারা এখনো তার নাম করার চেষ্টা করছেন। কথাবার্তা বলতে বলতেই নামটা মনে আসবে। এখন নামটা মনে করার চেষ্টা না করলেই ভালো হত। শান্তিমতি কথা বলতে পারতেন। একই সময় নাম মনে করার চেষ্টা এবং কথা বলার চেষ্টা করার জন্যে সবই এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে।
তোমাকে গতকাল আসার জন্যে খবর পাঠিয়েছিলাম।
জ্বি।
বলেছিলাম খুবই জরুরি ব্যাপার। বলেছিলাম না?
জ্বি।
তুমি আস নি কেন?
একটা সমস্যা হয়ে গেছে- সমস্যার জন্যে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।
কী সমস্যা?
পারিবারিক সমস্যা। আপনি কি জন্যে ডেকেছেন বলেন।
আমার ছেলে তোমাকে চাকরি থেকে বিদায় করে দিয়েছে, কিন্তু আমি করি নাই। বুঝতে পারছ?
জি।
তোমার নাম ভুলে গেছি— নাম কি মামুন?
জ্বি না, ছালেহ উদ্দিন।
তাহলে মামুন কার নাম?
এই নামে অফিসে কেউ নাই।
জাহানারার আবারো পানির পিপাসা হচ্ছে। অথচ একটু আগেই দুচুমুক পানি খেয়েছেন। তাঁর কি পিপাসা-রোগ হয়েছে? প্রবল তৃষ্ণা হয়— পানিতে ঠোঁট ড়ুবানো মাত্ৰই পিপাসার সমাপ্তি। আবার কিছুক্ষণ পর তৃষ্ণা।
জাহানারা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আবারো দুচুমুক পানি খেলেন। তাঁর তৃষ্ণা মিটে গেল। তিনি খাটে পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে হঠাৎ নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, শুভ্ৰ যে একটা খারাপ মেয়ের কাছে যায় এটা তোমরা জান?
ম্যানেজার সহজ গলায় বলল, জানি।
কীভাবে জান?
ছালেহ উদ্দিন চুপ করে রইল।
এই বিষয়ে তোমার মতামত কী?
দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মত কিছু না।
আমার ছেলে একটা খারাপ মেয়ের কাছে যায় এটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মত কারণ না? তুমি কি জন্ম থেকেই বোকা না বয়স বাড়ার সাথে সাথে বোকামি বাড়ছে।
আপনি হুকুম দিলে মেয়েটাকে সরায়ে দিব।
কোথায় সরিয়ে দিবে?
কোথায় সরাব সেটা আমার ব্যাপার। সব কিছুতো বলা যায় না। বলা ঠিকও না।
কবে সরবো?
সেটাও আমার ব্যাপার।
তুমি পারবে?
না পারার কিছু না।