পুরনো ধরনের বাড়িতে বাস্তু সাপের মত বাস্তু ভূতও থাকে। এরা মাঝে মাঝে দেখা দেয়। কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি করে না। জাহানারীদের এই দোতলা বাড়ি খুব কম করে হলেও দুশ বছরের পুরনো বাড়ি। মোতাহার সাহেবের দাদা আফসর উদ্দিন জজকোটের পেশকার দয়াল দাসের কাছ থেকে বাড়িটা সেই আমলে আঠারো হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। দয়াল দাস বাড়ি বিক্রির দলিলে সই করার দিন বললেন— বাড়িতে একটা প্ৰেত আনাগোনা করে তবে ভয়ের কিছু নেই। আমরা প্রতি অমাবশ্যায় প্রেতিটাকে ভোগ দিতাম। বড় শোল মাছ ভাজা। আপনারা মুসলমান, আপনারাতো প্রেতকে ভোগ দিবেন না। তবে দয়া করে দূর্ঘ্যবহার করবেন না। বাড়ি বন্ধক দিয়ে তাকে দূর করারার চেষ্টাও করবেন না। সে অনেকদিন এই বাড়িতে আছে। তাকে দূর করার দরকার নাই। সে থাকবে তার মত, আপনারা থাকবেন আপনাদের মত।
জাহানারার ধারণা তালগাছের মত রোগা লম্বা মেয়েটাই প্ৰেত। তিনি এই প্ৰেতটাকে যেমন দেখেছেন, আরো অনেকেই দেখেছে। সবচে বেশি দেখেছেন তার শ্বশুরু মেরাজ উদ্দিন। গভীর রাতে তার ঘর থেকে চাপা গলার শব্দ শোনা যেত। মেরাজউদ্দিন বলতেন— এই দূর হ। দুর হ মাগি। দূর হ। শ্বশুরের গলা শুনে জাহানারার ভয় ভয় লাগত। কাকে তিনি দূর হতে ঋলছেন— ঘরে তো কোনো মেয়ে নেই। থাকার মধ্যে আছে জুলহাস। মেরাজ উদিনের খাস খেদমতগার। জাহানারার খুব ইচ্ছা করত রাতে একবার গিয়ে শ্বশুরের ঘরে উঁকি দিতে। দেখার জন্যে কাকে তিনি দূর হতে বলছেন। মোতাহার সাহেবের কারণে সেটি সম্ভব হয় নি। বিয়ের রাতেই মোতাহার সাহেব স্ত্রীকে বলেছেন— সন্ধ্যার পর কখনো বাবার ঘরে উঁকি দিবে না। বারান্দাতেও যাবে না। জাহানারা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, কেন?
সন্ধ্যার পরে বাবা সামান্য নেশা টেশা করেন। মাথা ঠিক থাকে না। তোমাকে হঠাৎ চিনতে না পেরে কী বলতে কী বলে ফেলবেন দরকার কী? খবৰ্দার যাবে।
আচ্ছা, আমি যাব না।
দিনের বেলা বাবার কাছে যাবে। তাঁর সেবা যত্ন করবে। সন্ধ্যার পর কখনো না।
জাহানারার বিয়ের এক মাসের মাথায় তার শ্বশুরু দেয়ালে মাথা ফাটিয়ে মারা যান। তিনি যদি আরো কয়েক মাস বেঁচে থাকতেন তাহলে জাহানারা অবশ্যই কোনো এক রাতে উঁকি দিয়ে শ্বশুরের কাণ্ডকারখানা দেখে আসতেন। তাঁর কৌতূহল খুব বেশি।
বারান্দায় বিনুর ঘরের সামনে তারের ওপর সাদা রঙের কী যেন দুলছে। জাহানারার বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল—ব্রার মত দেখতে। বিনু তার ব্ৰা ঝুলিয়ে রাখে নি তো? জিনিসটা এমন জায়গায় ঝুলছে যেখান থেকে জানালা খুললেই শুভ্র দেখেতে পাবে। এই পাঁজি মেয়েটা এমন জঘন্য একটা কাণ্ড করতে পারল? ব্ৰা ঝুলিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা— ছিঃ ছিঃ। জাহানারা এগিয়ে গেলেন। এখন রাত বাজছে তিনটা। যত রাতই হোক জিনিসটা যদি ব্ৰা হয় তিনি বিনুকে ডেকে তুলবেন এবং এমন কিছু কথা বলবেন যা মেয়েটার সারাজীবন মনে থাকবে। ব্যাপারটা শুধু কথা দিয়েই শেষ হবে না, সকালবেলা বিনুকে চলে যেতে হবে। তার বাবা তাকে নিতে অ্যাসে নি তাতে কী— তিনি ম্যানেজার সাহেবকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। জাহানারা কাছে গিয়ে দেখলেন তাক্সের উপর সাদা তোয়ালে ঝুলছে। তবে তিনি যে ভেবেছিলেন— শুভ্রর জানালা খুললে এই জায়গাটা দেখা যায়। কারণ তিনি শুভ্ৰকে দেখতে পাচ্ছেন। সে খাটে বসে আছে। বই পড়ছে। তার কোলে মোটা একটা বই। আচ্ছা বিনু কি এখানে দাঁড়িয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে। মন ভুলানোর চেষ্টা করে? ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে। কিংবা শুভ্ৰকে বলতে হবে এই দিকের জানালাটা যেন বন্ধ রাখে।
জাহানারা শুভ্রর জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। শুভ্র বই থেকে মুখ না তুলে বলল, মা এত রাতে বারান্দায় হাঁটা হাঁটি করছ, কেন? শেষে তোমার সঙ্গে মহিলা ভূতটার দেখা হয়ে যাবে। তুমি ভয়টয় পাবে। ঘুমুতে যাও।
তুই ঘুমুচ্ছিস না কেন?
শুভ্র বই থেকে মুখ তুলে হাসিমুখে বলল, মা শোন, জেগে যখন আছ একটা কাজ করতে পারবে- চা খাওয়াতে পারবে? চা খেতে ইচ্ছা করছে। আমি নিজেই বানোতাম, এখন বই ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না।
কী বই পড়ছিস?
অন্ধাদের লেখাপড়া শেখার বই। যখন অন্ধ হয়ে যাব তখন এই বই-এর বিদ্যা খুব কাজে লাগবে।
শুভ্ৰ হো হো করে হাসছে। যেন অন্ধ হয়ে যাওয়াটা খুব মজার ব্যাপার। ময়না পাখিটা ঘুমুচ্ছিল, সে হাসির শব্দে জেগে উঠে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
মোতাহের সাহেব তাঁর অফিস ঘরে বসে আছেন
মোতাহের সাহেব তাঁর অফিস ঘরে বসে আছেন। পুরানা পল্টনের গলির ভেতর অফিস। অফিসটা যে বেশ বড় সড় বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে অনেক জায়গা। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়। ভেতরে প্রেস আছে। প্রেসের মালিক নতুন যামানা ধরনের নামের কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। যদিও অফিস ঘরের একটা সাইনবোর্ড আছে— M. Khan and Sons General Merchant, সাইনবোর্ডটা শ্বেতপাথরে লেখা। সেই শ্বেতপাথর অফিসের গেটে বসানো। এম খান হলেন মেরাজ উদ্দিন। মোতাহার উদিনের বাবা। তাঁর দুই ছেলের একজন দেশে আছে— অন্যজন সাবের খান থাকেন নিউজার্সিতে। একুশ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলেন এখন তাঁর বয়স পাঁচপঞ্চাস। এর মধ্যে দেশে আসেন নি। দেশের কারোর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগও নেই।
মোতাহার সাহেবের অফিস ঘর অন্য সব অফিস ঘরের মত না। বৈঠকখানা বৈঠকখানা ভাব। চেয়ার টেবিলের সঙ্গে একটা সিঙ্গেল খাটিও এক পাশে পাতা। খাটে মশারির স্ট্যান্ড লাগানো। মোতাহার সাহেব মাঝে মাঝে দুপুরে খাটে শুয়ে থাকেন। তখন মাছি খুব বিরক্ত করে বলে মশারি খাটান। তার খাস বেয়ারা মঞ্জু মশারির বাইরে বসে হাত বাড়িয়েঞ্জার পায়ের আঙুল টেনে দেয়। অফিস ঘরের দুটা বড় জানালা আছে। বাইরের হৈচৈ, বিশেষ করে ট্রাকের হর্ণ মোতাহার সাহেবের অসহ্য লাগে বলে জানালা সব সময় বন্ধ থাকে। শুধু বন্ধ না, জানালায় ভারি পর্দা টেনে দেয়া থাকে। কাজেই অফিস ঘরে সারাক্ষণ বাতি জ্বলে। লোড শেডিং-এর সময় মঞ্জু মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। হলুদ রঙের মোমবাতি। কোনো এক বিচিত্র কারণে মোতাহার সাহেব সাদা মোমবাতি সহ্য করতে পারেন না।