আমি এরকম করে ভাবি নি।
খুব বড় মাপের মানুষদের আমরা স্পর্শ করতে চাই- কারণ, আমরা তার শরীরের কিছু অংশ নিজের ভেতর নিয়ে নিতে চাই। ঠিক যে কারণে ভয়ঙ্কর মানুষদের স্পর্শ করতে নেই।
মেশকাত সাহেব্ব আমাকে চা খাওয়ালেন। নিজেই বানিয়ে খাওয়ালেন। একবারের জন্যেও মনে হল না মানুষটা চোখে দেখতে পান না। তিনি বাস করেন। আলোহীন জগতে।
শুভ্র।
জ্বি।
একটা হাইপোথেটিক্যাল ব্যাপার কল্পনা করুন। আমি হাত দিয়ে আপনাকে ছয়ে দিলাম। সেই কারণে আপনার শরীর থেকে কিছু ইলেকট্রন চলে এল আমার শরীরে। এমনওতো হতে পারে তাদের কাছে আপনার ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য থাকতে পারে। সেই তথ্য হয়তো সবাই ধরতে পারে না। কেউ কেউ পারে।
আমি চায়ে চুমক দিতে দিতে বললাম, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন— ইলেকট্রনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা আপনার আছে?
মেশকাত সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করলাম। এর বেশি কিছু না। বিজ্ঞান রহস্যময়তা অপছন্দ করে অথচ সবচে রহস্যময় ব্যাপারগুলি কিন্তু ঘটাচ্ছে বিজ্ঞান। আমাদেরকে পরম রহস্যের দিকে এই বিজ্ঞানই কিন্তু ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বলুন নিয়ে যাচ্ছে না?
হ্যাঁ, নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে সময় আছে- অতীত আছে, বর্তমান আছে, অনাগত ভবিষ্যত আছে। সেখানে আপনাদের বিজ্ঞান যদি বলে বসে। অতীতবর্তমান-ভবিষ্যত বলে কিছু নেই তখন ধাক্কার মতো লাগে না?
হ্যাঁ, লাগে। আপনি কি বিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেন?
মোটেই পড়াশুনা করি না। অন্যরা বলে, আমি শুনি। যা ভাল লাগে মনে করে রাখি। মানুষকে চমকে দেবার জন্যে আহরিত এই জ্ঞান ব্যবহার করি। সত্যি করে বলুন তো শুভ্ৰ- আপনি চমকান নি?
হ্যাঁ, চমকেছি।
অন্যকে চমকে দিয়ে মজা দেখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে খুব বেশি আছে। আর সবচে বেশি আছে প্রকৃতির মধ্যে। প্রকৃতি সবসময়ই মানুষকে চমকাচ্ছে। প্রকৃতির কাণ্ডকারখানা দেখে আমার মনে হয়— মানুষকে চমকে দিয়ে সে খুব মজা পায়। কাজেই, শুভ্ৰ শুনুন–যদি কখনো ভয়ঙ্কর ভাবে চমকে ওঠার মত কোনো ঘটনা আপনার জীবনে ঘটে আপনি বিচলিত হবেন না। সহজ থাকবেন। শান্ত থাকবেন। এবং ভেবে নিবেন— এটা কিছুই না। প্রকৃতির মজা মজা খেলার অংশ।
এটাই কি আমার বিষয়ে আপনার ভবিষ্যত বাণী?
মেশকাত সাহেব হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এটা আমার একটা খেলাও হতে পারে। চমক চমক খেলা। গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু কথা বলে চমকে দেয়া।
আকাশ মেঘে মেঘে কালো
আকাশ মেঘে মেঘে কালো।
বিছানায় শুয়ে খোলা জানালায় আকাশ দেখার শখ জাহানারার কখনোই ছিল। না। কয়েকদিন ধরে দেখছেন। দেখতে যে ভাল লাগছে তা-না। আবার খারাপও লাগছে না। ঘরের ভেতর থেকে দৃষ্টি বের করতে পারছেন এটাই একমাত্র আনন্দ। ঘরের ভেতর থাকতে ইচ্ছা করছে না। দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে। বিনুকে নিয়ে কোথাও গেলে হয়। মানুষ তার এক জীবনে কত জায়গায় বেড়াতে যায়— কোলকাতা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা। তিনি কোথাও যান নি। শুভ্ৰর বাবার বেড়ানোর অভ্যাস ছিল না। পাসপোর্ট পর্যন্ত করেন নি। যে মানুষ নিজের ঘরের বাইরে পা ফেলে না, তারও একটা পাসপোর্ট থাকে। শুভ্রর বাবার তাও ছিল না। মেয়েদের জীবনতো আয়নার মত। স্বামীর আয়না। স্বামী যা করবে। আয়নায় তারই ছায়া পড়বে। জাহানারারও তাই হল। শুভ্রর বাবার সঙ্গে দোতলা একটা বাড়িতে আটকা পড়ে গেলেন। শুভ্রর বাবার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে কোনো ভবঘুরের সঙ্গে যদি তাঁর বিয়ে হত তাহলে তিনিও ভবঘুরে স্বামীর মত ভবঘুরে হতেন।
জাহানারাক্স পানির পিপাসা হচ্ছে। পানির জন্যে কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে। না। এক সময় না এক সময় বিনু তাঁর ঘরে আসবে। তাকে পানির কথা বললেই হবে। আকাশ এখন ঘন কালো। আজ মনে হয় বৃষ্টিতে শহর ভেসে যাবে। ছোটবেলায় তাঁর বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল। উঁহু, ভুল বলা হল— তাঁর বাবা কয়েস উদ্দিন আকন্দ সাহেবের বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল। তিনি ঝুম বৃষ্টি হলেই ছাদে ভিজতে যেতেন। ভিজতে যাবার আগে খুশি খুশি গলায় ডাকতেন— কইরেটুনটুনি, বৃষ্টিতে ভিজবি? বৃষ্টির পানিতে ভিজলে গায়ের ঘামচি মরে। আয় দেখি।
বিয়ের পর আর কোনোদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি। শুভ্রর বাবার কোনো আজগুবি শখ ছিল না। কিংবা কে জানে হয়ত তারও অনেক আজগুবি শখ ছিল— অন্যরা জেনেছে, তিনি কখনো জানতে পারেন নি। মানুষ হয়ে জন্মলে আজগুবি শখ থাকবেই। জাহানারার শীত শীত লাগছে। তিনি গায়ের ওপর চাঁদর টেনে দিলেন আর তখনি বিনু ঢুকল। নিচু গলায় বলল, চাচি, পুরনো ম্যানেজার সাহেব এসেছেন, ছালেহ উদ্দিন সাহেব।
জাহানারা বললেন, ওকে গতকাল আসতে বলেছিলাম। একদিন পরে এসেছে কেন?
বিনু জবাব দিল না। জাহানারা বললেন, ও এসেছে বসে থাকুক। আমার যখন ইচ্ছা হবে ডাকব! আবার নাও ডাকতে পারি। তুমি বোস। চেয়ারটা টেনে বোস। তোমার সঙ্গে গল্প করি।
বিনু বসতে গেল। জাহানারা বললেন, এক কাজ কর— এক কাপ চা এবং ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি এনে তারপর বোস। বিনু বলল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
জাহানারা বললেন, আমার শরীর খারাপ ও লাগছে না, আবার ভালও লাগছে। না। শুভ্ৰ কি ফিরেছে?
না।
কাল রাতেও ফিরে নি?
না।
কোথায় ছিল তুমি জান?
না।
জাহানারা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কাল রাতে ও কোথায় ছিল তা তুমি জান, আমিও জানি। অথচ দুজনই ভাব করছি কিছু জানি না। আচ্ছা যাও, চাপানি নিয়ে এসো। কাজের মেয়েটাকে বলে এসো ম্যানেজারকেও যেন এককাপ চা দেয়।