খুব আনন্দ লাগছে?
হ্যাঁ খুবই আনন্দ লাগছে। আমার মাথায় এখন কিছু নেই; শুধুই আমার মেয়ে। আখলাক বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। আমি জেগে থাকি এবং মেয়ের সঙ্গে কথা বলি।
মেয়ের সঙ্গে কথা বল?
হ্যাঁ। সিরিয়াস ধরনের কথা। তোকে নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। অনেক আঙ্গুমেন্ট হয়। তর্কে আমি ওর কাছে সব সময় হেরে যাই। আমি ওর নাম দিয়েছি তর্ক-সমাজ্ঞী। তোকে নিয়ে যখন তর্ক হয় তখন সে সব সময় তোর পক্ষ নেয়।
মীরা কথা বলছে- আমি অস্বাক হয়ে দেখলাম মেয়ের কথা বলতে বলতে তার চোখ ভিজে উঠছে।
ভালবাসা ব্যাপারটা কী? যে মানুষটি পৃথিবীতেই এখনো আসে নি তার প্রতি এমন গভীর গাঢ় ভালবাসা কীভাবে তৈরি হয়? এই ভালবাসা কেমন ভালবাসা?
মীরার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সে বলল, তুই একটা কাজ করিাসতো— মেশকাত সাহেবের সঙ্গে দেখা করিস। দেখি উনি কী বলেন। বিশেষ কিছু জানতে চাইলে উনাকে স্পেসিফিক্যালি জিজ্ঞেস করবি।
আমি বললাম, আধুনিক পদাৰ্থ বিদ্যা কি এইসব বিশ্বাস করে?
তোর ধারণা করে না?
না।
আমার ধারণা করে। সাবে এটমিক লেভেলে চিন্তা কর শুভ্ৰ— মানুষ সেই লেভেলে কি দিয়ে তৈরি? আপকোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম। জিনিসগুলি আসলে কী? নাথিং।
জিনিসগুলি আসলে কী তার সঙ্গে মেশকাত সাহেবের বলার কোনো সম্পর্ক নেই।
তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না— শুভ্ৰ তোকে আমার ধারণার কথাগুলি বলি– we really do not exist, এই যে তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস, আমি তোর সঙ্গে গল্প করছি— এগুলি কিন্তু ঘটছে না। আমরা হচ্ছি কোনো একজনের কল্পনা। সেই কোনো একজনটাই হয়ত God. The one and the only.
আমি তাকিয়ে আছি। মীরা হাত নাড়তে নাড়তে গল্প করছে। তাকে দেখতে ভাল লাগছে। আমি মীরার গল্পে বাধা দিয়ে বললাম, আমার ধারণা তুমি এইসব উদ্ভট থিয়োরি রাত জেগে জেগে আখলাক সাহেবকে শোনাও। এবং উনি খুব মন দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত শুনেন।
মীরা হাসতে হাসতে বলল, তা শুনে এবং যা বলি বিশ্বাস করে। আখলাকের এই অংশটি আমার খুব পছন্দ। তোকে বিয়ে করলে পছন্দের এই অংশটি থেকে আমি বঞ্চিত হতাম। ভাগ্যিস তোকে বিয়ে করি নি।
আমাকে বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন?
কথার কথা বললাম। তোকে কিংবা তোর মত কাউকে। অবশ্যি তোর কথা একেবারেই যে ভাবি নি তা না।
মীরা হাসছে। এই হাসি এবং ক্যাসেটের হাসি এক না। অনেক আলাদা। মানুষের হাসি নিয়ে কেউ গবেষণা করে নি। করা উচিত ছিল। চিস্তা চেতনার পরিবর্তনের সঙ্গে হাসির শব্দ বদলে যায়। শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বদলায়। কিছু ফ্রিকোয়েন্সি বাদ পড়ে কিছু নতুন ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত হয়; কেন এইসব নিয়ে কেউ ভাবছে না? রহস্যময় মানুষ কেন রহস্যের কুঠুরি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে। না? মেশকাত সাহেবের মত মানুষরা আসলে কী করেন?–অর্জন উঁচিয়ে রহস্যময় সেই জগতের প্রতি ইঙ্গিত করেন? বুঝেই করেন না বুঝেই করেন?
মেশকাত সাহেব আমাকে চিনতে পারলেন। চোখের মত শক্তিমান ইন্দ্রীয় থেকে বঞ্চিত মানুষদের অন্য ইন্দ্রীয়গুলি তীক্ষ্ম হয় এটা জানা কথা। তাই বলে এত তীক্ষ্ণ!
মেশকাত সাহেব লুঙ্গি পরে আছেন, খালি গী। গায়ের ওপর পাতলা চাঁদর জড়ানো। মানুষটা ধবধবে ফর্সা। আখলাক সাহেবের বাড়িতে তাঁর গায়ের এমন রঙ চোখে পড়ে নি। মেশকাত সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সহজ গলায় বললেন, আপনি শুভ্ৰ? আখলাক সাহেবের বাড়িতে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল।
জ্বি।
পার্টি শুরু হবার আগেই আপনি মীরার সঙ্গে চলে গেলেন। মীরা ফিরে এল, আপনি ফিরলেন না।
জ্বি। এতসব আপনার মনে আছে?
অবশ্যই মনে আছে। মনে রাখাই আমার কাজ। অন্য কোনো কাজতো হাতে নেই। আমার মত অবস্থা যদি আপনার হোত আপনিও সব কিছু মনে রাখতেন।
ব্রেইলী পদ্ধতি ব্যবহার করে পড়াশোনা করার কথা কখনো ভেবেছেন?
ভেবেছি। সেই সুযোগ কোথায়?
আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
শুভ্ৰ, আমি কারো সাহায্য নেই না।
যে কারোর সাহায্য নেয় না, সে তো কাউকে সাহায্যও করে না।
আপনি কি আমার কাছে কোনো সাহায্যের জন্যে এসেছেন?
না। জানতে এসেছি।
আমার কাছে কী জানতে চান?
অতীন্দ্রীয় ক্ষমতা বলে কিছু কি আছে? ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ক্ষমতার বাইরে কোনো ক্ষমতা।
মূল ক্ষমতার সবটাইতো ইন্দ্রীয়ের ধরা ছোয়ার বাইরে। সামান্য যে ইলেকট্রন একেও তো আপনি হাত দিয়ে ছুঁতে পারছেন না, অনুভব করতে পারছেন না, গন্ধ নিতে পারছেন না, দেখতে পারছেন না।
আমি না পারলেও আমার তৈরি যন্ত্রপাতি পারছে। পারছে বলেই আমরা বলতে পারছি ইলেক্ট্রন কী, তার ধর্ম কী?
তাও পারছেন না। পারছেন না বলেই একবার বলছেন ইলেক্ট্রন বস্তু, আরেকবার বলছেন তরঙ্গ।
ইলেকট্রন হচ্ছে একই সঙ্গে বস্তু এবং একই সঙ্গে তরঙ্গ।
খুব হাস্যকর কথা বলছেন না? আপনি নিজের মনকে জিজ্ঞেস করুন—কথাটা হাস্যকর না?
আমি চুপ করে রইলাম। মেশকাত সাহেব বললেন, মীরার কাছে শুনেছি আপনি ছাত্র হিসেবে অসাধারণ, মানুষ হিসেবে অসাধারণ। দুই অসাধারণ যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার হাতটা আমি একটু ছুঁয়ে দেখি।
দেখুন বলে আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, শুনেছি আপনি মানুষের হাত ছুঁয়ে অনেককিছু বলতে পারেন। আমার ব্যাপারে বলুন তো শুনি।
মেশকাত সাহেব হালকা গলায় বললেন, ভুল শুনেছেন। আমি হাত ধরে কিছুই বলতে পারি না। তবে হাত ধরাটাকে তুচ্ছ করবেন না। যেই মুহুর্তে আমি আপনার হাত ধরলাম। সেই মুহূর্তে কী হয় জানেন— আপনার শরীরের কিছু ইলেকট্রন কিছু সাব এটোমিক পার্টিকেল আমার শরীরে চলে আসে। আমার কিছু চলে যায় আপনার মধ্যে। হাত ধরা মানে তার কিছু অংশ নিজের ভেতর নিয়ে নেয়া।