হ্যালো বিনু!
জ্বি বলুন।
হঠাৎ মনে হল টেলিফোনের কানেকশন কেটে গেছে। মোবাইল সেটগুলির এই সমস্যা- জরুরি কথার মাঝখানে লাইন কেটে যাবে।
আপনিতো কোনো জরুরি কথা বলছেন না।
এই জন্যেইতো লাইন কাটছে না। আমি এখন কী করছি বলতো?
একটু আগেই আমাকে বলেছেন কী করছেন— গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন। বৃষ্টি দেখছেন।
ফিফটি পারসেন্ট হয়েছে। আমি আসলে ডায়েরি লিখছি। আমি মাঝে মাঝে অদৃশ্য খাতায় অদৃশ্য কলমে ডায়েরি লিখি। বুঝতে পারছ?
জ্বি না।
আরেক দিন বুঝিয়ে দেব। আচ্ছান্ন শোন বিনু, আমাকে কি খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
আমি খুবই আনন্দিত।
কেন?
কারণটা আমি জানি। কিন্তু তোমাকে বলব না। হ্যালো বিনু।
জ্বি শুনছি।
তোমার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছি না। মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। টিক টিক করে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে পােচ্ছ না?
পাচ্ছি।
হ্যালো বিনু!
জ্বি বলুন।
আমি খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকের টেলিফোনটা করেছি। সেই সিদ্ধান্তটা তোমাকে জানানোর জন্যে।
বলুন আমি শুনছি।
বিনু কিছু শুনতে পেল না। শুভ্রর মোবাইল সেটের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।
শুবরু, শুবরু
কে যেন ডাকল, শুবরু, শুবরু।
আমি চোখ বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সীটে বসে আছি। বৃষ্টির শব্দ শোনার চেষ্টা করছি। গাড়ির কাচ উঠানো। তারপরেও বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ কানো এল শুবরু শুবরু! কেউ যেন এই নামে ডেকে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটে আসছে।
আমি নিজের অজান্তেই কে বলে চোখ মেললাম। গাড়ির ড্রাইভার গাড়িতে হঠাৎ ব্রেক করে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, কিছু না তুমি চালাও। সে আবার একসিলেটার চাপ দিল। সে এখনো স্বস্তিবোধ করছে না। তার চোখ ব্যাক ভিউ মিররের দিকে। আমাকে মনে হয়। সেই আয়নায় খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এই ড্রাইভারকে নতুন রাখা হয়েছে। যে-কোনো কারণেই সে আমাের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। যতবারই আমি তাকে ডাকি সে চমকে ওঠে। অফিসের বারান্দায় বসে সে চা খাচ্ছিল। আমি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তার দিকে তাকলাম— দেখি, তার চোখ ভয়ে ও আতংকে কাঁপছে।
আমাকে সে কেন ভয় পায়? আমরা যে জিনিস বুঝতে পারি না তাকেই ভয় পাই! সে আমাকে বুঝতে পারছে না বলেই ভয় পাচ্ছে। এই মুহুর্তে সে কী ভাবছে? সে ভাবছে ছোট সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন, হঠাৎ কেন জেগে উঠে বললেন- কে? আমি তাকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলে সে কি আশ্বস্ত হবে? আমি কি তাকে বলব, রশীদ শোন, দুটা জিনিস মানুষকে তাড়া করে। একটার নাম স্বপ্ন। সে সামনে থেকে তাকে ডাকে। মানুষ তার দিকে ছুটে যায়। আরেকটার নাম স্মৃতি। সে ভয়ংকর কোনো জন্তুর মত পেছন থেকে তাড়া করে। একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তিনি প্রচুর জর্দা খেতেন। ফুলের সৌরভের মত, জর্দার সৌরভ তাঁকে ঘিরে থাকতো। ঐ ভদ্রলোক আমাকে ডাকতেন শুবরু নামে। তিনি চলে গেছেন, নামটা ফেলে রেখে গেছেন। ঐ নামটা মাঝে মাঝেই আমাকে তাড়া করে। একটু আগেও করছিল বলে ভয়ে পেয়ে আমি বলেছিলাম— কে?
ঐ বুড়ো ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে বা তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার খুব কথা বলার শখ। তাদের কাছে আমি জানতে চাইব।— বুড়ো ভদ্রলোক শুবরু নামের বাচ্চা একটা ছেলেকে এতটা ভাল কেন বেসেছিলেন। কার্যকরণহীন ভালবাসা বলে এ জগতে কিছু নেই। সব কিছুর পেছনে কারণ আছে। প্রথমে cause তারপর affect, ভালবাসাটা যদি affect হয় তার পেছনের cause টা কী?
আমি ঐ বুড়ো মানুষের পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাইব— আপনারা কি আমাকে উনার সম্পর্কে বলবেন? আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনেছি। মৃত্যুর আগেও তিনি শুবরুকে ডেকেছেন। কেন ডেকেছেন? তিনি শুবরু সম্পর্কে কি বলতেন? আচ্ছা শুবরুকে কোলে নিয়ে তার কি কোনো ছবি আছে? একটা ছবি তিনি আমাকে নিয়ে স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছেন। এবং আমাকে লজ্জিত গলায় বলেছেন— ছবি তোলার কথা বড় সাহেবরে বলব না। উনি রাগ হতে পারেন।
আমি বলেছিলাম, রাগ হবেন কেন? ছবি তোলা কি খারাপ?
না খারাপ না। ব্যাপারটা হল কী শুবরু, মানুষ আল্লাহপাকের আজব সৃষ্টি। সে খারাপ কাজে রাগ হয়, ভাল কাজের জন্যেও রাগ হয়। আবার ধর ভাল না, খারাপ না এমন কাজের জন্যেও রাগ। মানুষ বড়ই আজব জানোয়ার।
মানুষ আজব জানোয়ার কেন?
আল্লাহপাক মানুষকে আজব করে বানিয়েছেন এই জন্যে।
আল্লাহপাক মানুষকে আজব করে কেন বানিয়েছেন?
এইটাইতো বাবা বুঝি না। প্রায়ই চিন্তা করি— কুল পাই না। তিনিতো কত কিছুই সৃষ্টি করলেন। মানুষকে আজব করলেন কেন? তিনি নিজে খুবই আজব এই জন্যে?
উনি কি খুবই আজব?
উনি কী, কেমন কিছুই জানি না বাবা।
আপনি জানেন না কেন?
আমার তখন প্রশ্নকাল চলছে। শুধুই প্রশ্ন করি। এবং তিনি ক্লান্তিহীন ভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান। আমার প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলি লিখে রাখলে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার জানা যেত। একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষের পৃথিবী সম্পর্কে ধ্যান ধারণা?
বুড়ো মানুষের পরিবারের কাউকেউ আমি খুঁজে পাই নি। বুড়ো মানুষটার মত সবাই হারিয়ে গেছে। আমার সকল চেষ্টাই বিফলে গেছে। আমি হাল ছেড়ে দেই নি। সবশেষে চায়না ভাইকে বললাম, এদের কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে?
চায়না ভাই আমাকে চমকে দিয়ে বলল— অবশ্যই। আপনি হুকুম দেন। আমি বাইর করি। একমাসের ভিতরে যদি বাইর করতে না পারি চায়না ভাই নাম বদলাইয়া আমি নিজের নাম রাখব চায়না ভইন।