জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মন বেশ খারাপ হয়েছে, কারণ শুভ্ৰকে দেখে মনে হচ্ছে না জন্মদিনের কেক, মোমবাতি এইসব দেখে সে খুশি হয়েছে। তার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে। সে দুবার হাই তুলল। মার দিকে তাকিয়ে বলল, কেকটা খেতে ইচ্ছা করছে না মা।
জাহানারা গন্ত্রীর গলায় বললেন, খেতে ইচ্ছা না হলে খাবি না। এটা তো ওষুধ না যে জবরদস্তি করে খাওয়াতে হবে।
তুমি রাগ করছ না-কি?
তুই কেক খাবি না। এতে আমার রাগ করার কী আছে?
ঠিক আছে মা, তুমি আমাকে ছোট্ট দেখে একটা পিস দাও।
ইচ্ছে করছে না, শুধু শুধু খাবি কেন?
তোমাকে খুশি করবার জন্যে খাব। মাকে খুশি করার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন। আমি না হয় এক পিসি কেকই খেলাম।
মোতাহার সাহেব বললেন, মাকে খুশি করার জন্যে বিদ্যাসাগর এই কাজ করেন নি। তার মাকে দেখতে যেতে ইচ্ছা করছিল। খেয়া নৌকা ছিল না। তাই নদী সাঁতরে পার হয়েছেন।
শুভ্র বলল, এই খবর জেনে তাঁর মা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন।
যে-কোনো মা-ই খুশি হবে।
শুভ্ৰ হাসি হাসি মুখে বলল, তাহলে বাবা আমার স্টেটমেন্টেতো ভুল নেই।
অসহ্য লাগছে।
শুভ্ৰ কেক খাচ্ছে। জাহানারার মনে হল কেকটা শুভ্র খুব আগ্রহ করেই খাচ্ছে। এই পিস শেষ করার পর সে হয়তো আরেকটা পিস খেতে চাইবে। জাহানারা বললেন, খেতে কেমন লাগছেরে শুভ্ৰ?
ভাল।
আরেক পিস খাবি?
খাব। আচ্ছা মা, বিনু মেয়েটাকে কখনো হাসতে শুনেছো?
জাহানারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। স্বামীর দিকেও একবার তাকালেন; শুভ্ৰ বিনুর প্রসঙ্গে কথা বলবে কেন? বিনু কে? ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে। পরীক্ষা দেয়া হয়েছে, এখন চলে যাবে। তার সম্পর্কে কথা কেন?
শুভ্র বলল, মা তুমি বিনুর হাসি কি শুনেছ?
জানতে চাচ্ছিস কেন?
আমার একটা দরকার আছে। এখন তোমাকে বলা যাবে না। তোমাদের জন্যে একটা সারুপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বিনুর হাসি কি তুমি শুনেছ?
জাহানারা বললেন, না শুনি নি। সবোক্স হাসি শুনে বেড়ানোর সময় আমার নেই। বিনুর সাথে কি তোর প্রায়ই কথা হয়?
মাঝে মাঝে কথা হয়, তবে ওকে কখনও খিলখিল করে হাসতে শুনি নি।
জাহানারার ভুরু কুঞ্চিত হল। মোতাহার সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। শুভ্র বলল, তোমরা এত অবাক হচ্ছ। কেন মা? বিনুর সঙ্গে কথা বলা কি নিষিদ্ধ? জাহানারা কিছু বললেন না। শুভ্র খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমি এখনো বিয়ের কথা ভাবছি না। ভাবলে…।
জাহানারার কঠিন গলায় বললেন, ভাবলে কী?
শুভ্র বলল, না কিছু না।
শুভ্রর মুখ হাসি হাসি। তার চোখে রহস্যময় আলো। এই সবের মানে কী?
অসুস্থ মানুষের সঙ্গে ঘুমুতে গেলে জাহানারার নিজেকে অসুস্থ লাগে। অসুখটাকে জীবন্ত মনে হয়। মনে হয় জীবস্তু অসুখ হাত বাড়িয়ে তাঁকে ছয়ে দিচ্ছে। কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। ঘেন্না লাগলেও উপায় নেই অসুস্থ স্বামীকে এক বিছানায় রেখে তিনি অন্য বিছানায় শোবেন তা হয় না। সমাজে বাস করলে সমাজের নিয়ম কানুন মেনে বাস করতে হয়।
জাহানারা শুয়ে আছেন, তার ঘুম আসছে না। নিজেকে কেমন অশুচি অশুচি লাগছে। তিনি ঠিকমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। খারাপ একটা গন্ধ পাচ্ছেন। সব রোগের গন্ধ আছে। কেউ সেই গন্ধ পায় না। কিন্তু তিনি পান। মোতাহার সাহেবের গা থেকে অসুখের গন্ধটা খুব কড়া করে তাঁর নাকে আসছে। নিশ্চয়ই অসুখ বেড়েছে। জাহানারা নিচু গলায় বললেন, এই ঘুমিয়ে পড়েছ?
মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। জাহানারা খুব সাবধানে উঠে বসলেন। অসুস্থ মানুষের পাশে জেগে শুয়ে থাকার চেয়ে বারান্দায় হাঁটাহাটি করা ভাল। হাঁটাহাটির জন্য এ বাড়ির বারান্দাটা ভাল। বিরাট বারান্দা। শুধু পূর্ব-পশ্চিম খোলা। সেই দুই দিকে গ্ৰীল নেই। দক্ষিণ দিকে দুটা বড় ঘর। একটাতে থাকছে শুভ্ৰ। অন্যটায় আপাতত বিনু থাকছে। বিনু যে ঘরে আছে। এই ঘরটা শুভ্রর ঘরের চেয়েও সুন্দর। ফালতু টাইপ একটা মেয়েকে এত বড় ঘরে থাকতে দেয়া উচিত না। কিন্তু জাহানারা থাকতে দিয়েছেন। কারণ এই ঘরটা ভাল না। জাহানারার শ্বশুর মেরাজ উদ্দিন এই ঘরে থাকতেন। শেষ বয়সে তিনি পুরোপুরি পাগল হয়ে যান। মারা যান দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে। ঘরটা সেই কারণেই দোষী। বিনুদের মত মেয়েদের জন্য দোষী ঘরই ভাল। উত্তর দিকে রান্নাঘর ছাড়াই পাঁচটা কামরা। একটাতে তিনি থাকেন। অন্য সব ঘর খালি। এর মধ্যে একটা বসার ঘর। যদিও বসার ঘরে কাউকেই বসানো হয় না।
একতলায় সুন্দর একটা বসার ঘর আছে! কেউ এলে সেই বসার ঘরে বসানো হয়। তাদেরকে দোতলায় আনা হয় না। বাইরের কেউ দোতলায় উঠুক এটা জাহানারার খুবই অপছন্দ। যত কাছের আত্মীয়ই হোক তাদের বসতে হবে একতলার বসার ঘরে। জাহানারাকে খবর দিলে তিনি দোতলা থেকে নিচে নামবেন। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন কেউ যদি এক দুরাত থেকে যায়। তাদের জন্যে একতলাতেই ব্যবস্থা আছে। মোতাহার সাহেবের অফিসের কিছু লোকজন একতলায় থাকে। তাদের জন্যেও দোতলা নিষিদ্ধ।
জাহানারা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বারান্দায় আলো আছে। শুভ্ৰর ঘরেও আলো জুলছে। শুভ্ৰ জেগে আছে। তারপরেও জাহানারার গা সামান্য ছমছম করছে। এই বারান্দায় তিনি কিছু কিছু ভৌতিক ব্যাপার নিজে দেখেছেন। প্রায় ছফুট লম্বা রোগা একটা মেয়েকে দেখেছেন বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে যেতে। শেষবার দেখেছেন গত বৎসর নভেম্বর মাসে। মেয়েটা হাঁটছে, মাথা নিচু করে হাঁটছে, মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে জাহানারার দিকে তাকাল। তারপর আবার আগের মত হাঁটতে শুরু করল। যেন জাহানারার উপস্থিতিতে তার কিছুই যায় আসে না। মেয়েটা মিলিয়ে গেল গ্ৰীলের কাছে গিয়ে।