পাখিটা আমার পছন্দ হয়েছে।
মোতাহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, পছন্দ কদিন থাকে এটা হচ্ছে কথা। পশু-পাখি পোষা যন্ত্রণার মত।
জাহানারা বললেন, তোর বাবার উপহার তোর খুব পছন্দ সেটা বুঝতে পারছি। আমার উপহারটা পছন্দ হয় কি-না দেখতো।
মোতাহার সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, তুমি কী দিচ্ছ?
আগে বলব কেন? ও গিফট র্যাপ খুলে নিজেই দেখুক।
জাহানারা গিফটের ছোট্ট প্যাকেটটা ছেলের দিকে দিলেন। শুভ্ৰ প্যাকেট খুলছে। জাহানারা ধরার চেষ্টা করছেন— ছেলেটা প্যাকেট খোলার কাজটা কি আনন্দের সঙ্গে করছে? না-কি অনগ্রহের সঙ্গে করছে? মনে হয় না খুব আগ্রহের সঙ্গে খুলছে। হাত দিয়ে প্যাকেট খুলছে, তাকিয়ে আছে অন্য দিকে। আগ্রহ নিয়ে খুললে প্যাকেটের দিকেই তাকিয়ে থাকত।
তিনি ছেলের জন্য একটা দামি সিগারেট লাইটার কিনেছেন। পাথরের লাইটার। ঘন্টায় পনেরো কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলেও এই লাইটার জ্বালানো যাবে। তিনি জানেন শুভ্ৰ সিগারেট খায় না। তাতে কী— কখনো সখনো খাবে। ছেলেকে লাইটার উপহার দেবার পেছনে আরেকটা কারণ আছে। তিনি বলতে চাচ্ছেন- শুভ্ৰ তুমি বড় হয়েছ। লাইটার পেয়ে ছেলে কী করে কে জানে। শুভ্র যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন তাকে শেভিং রেজার কিনে দিয়েছিলেন। শেভিং রেজার, শেভিং ক্রম, ব্ৰাশ। শুভ্ৰ কাঁদো কাদো গলায় বলেছিল- মা, শেভিং-এর জিনিসপত্র কিনে দিলে কেন? তিনি বললেন, ওমা গাল ভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। নাকের নিচে গোঁফ- তুই শোভ করবি না? দাড়ি গোঁফ রেখে সন্ন্যাসী হবি? এই কথায় শুভ্রর চোখে পানি এসে গেল এবং সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কোনোদিন দাড়ি গোঁফ ফেলব না। আশ্চর্য কাণ্ড সত্যি সত্যি সে তাই করল। কলেজের পুরো দুবছর মুখভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। কী বিশ্ৰী অবস্থা! সবাই হাসাহসি করে। এর মধ্যে তাদের এক টিচার শুভ্ৰকে ডেকে বললেন— যারা জীবনে কখনোই দাড়ি গোঁফ ফেলে না তারা বেহেশতে লাইলী-মজনুর বিয়ে খেতে পারে বলে শুনেছি। তুমি ঐ বিয়ের দাওয়াত খাবার ব্যবস্থা করছ?
কে জানে আজ সে সিগারেট লাইটার নিয়ে কী করে। মনে হয় না কিছু করবে। সে তো আর ছেলেমানুষ শুভ্ৰ না; বড় হয়েছে।
শুভ্র লাইটার হাতে নিল; মার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, মা আমি সিগারেট খাই না।
জাহানারা আনন্দিত গলায় বললেন, সেটা তোকে বলতে হবে না, আমি জানি। শখে পড়ে যদি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে কখনো খাস। আর না খেলেও থাকল একটা লাইটার। মাঝে মধ্যে আগুন জ্বালাবার দরকার পড়ে না? ধর ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। মোম খুঁজে পেয়েছিস কিন্তু দেয়াশলাই পাচ্ছিস না।
তোমাকে এত ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা। তোমার উপহার। আমার পছন্দ হয়েছে।
পাথরটা সুন্দর না?
হ্যাঁ পাথরটা সুন্দর। এই পাথরটার নাম ম্যালাকাইট। ম্যালাকাইট খুব সুন্দর পাথর।
মোতাহার সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী নাম বললি?
ম্যালাকাইট।
তুই পাথর চিনিস না-কি?
সব পাথর চিনি না। দুএকটা চিনি। তুমি আঙ্গুলে যে আংটি পরে আছে তার পাথরটা হল Agate, বাংলায় বলে আকিক।
রাসুলাল্লাহ আকিক পাথর পরতেন। এক পামিস্টকে হাত দেখিয়েছিলাম। সে বলেছিল চুনি পাথর পরতে, তাহলে স্বাস্থটা ভাল থাকবে। চুনি পাথর দেখলে চিনতে পারবি?
পারব। লাল পাথর। তবে পাথরে স্বাস্থ্য ভাল হয় না। সব পাথরই আসলে এলুমিনিয়াম অক্সাইড। কোনো এলুমিনিয়াম অক্সাইডে সামান্য লোহা থাকে, কোনোটায় কপার। চুনি পাথরও যা নীলাও তা। সব পাথর আসলে এক।
মোতাহার সাহেব বললেন, সব মানুষইতো এক রকম। নাক-মুখ-চোখ নিয়ে মানুষ। তার পরেও একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো মিল আছে? তোর মত আরেকজন শুভ্ৰ কি আছে?
বাবা আমিতো পাথর না। আমি মানুষ।
জাহানারা বললেন, এত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে ভাল লাগছে না, চল পায়েস খেতে যাই।
মোতাহার সাহেব বললেন, এখানে আনতে পারবে না?
জাহানারা বললেন, এখানে আনতে পারব না। খাবার ঘরে চল। শোবার ঘরে খাওয়া দাওয়া আমার একটুও পছন্দ না। খাবার পড়ে থাকে, পিঁপড়া ওঠে।
মোতাহার সাহেবের উঠতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু জাহানারা গোপনে তাঁকে চোখ ইশারা করলেন। খাবার ঘরে জন্মদিন উপলক্ষে অন্য কিছু আছে। মনে হয় মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। কেকও থাকতে পারে। গত বছর ছিল।
জাহানারা খাবার ঘরে ঢুকে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। বিনুকে যেভাবে সব গুছিয়ে রাখতে বলেছিলেন সে সেভাবে কিছুই করে নি। কেকের চারপাশের তিনটা মোমবাতি বাঁকা হয়ে আছে। টপটপ করে কেকের ওপর মোম গলে গলে পড়ছে। পায়েস খাবার জন্যে লাল বাটি বের করতে বলেছিলেন, সে বের করেছে নীল বাটি। তারা তিনজন মানুষ, তিনটা বাটি বের করার কথা। সে বের করেছে। চারটা। তার মানে কী? মেয়েটা কি মনে করেছে সে নিজেও সবার সঙ্গে পায়েস খাবে! এত সাহস কেন হবে? জাহানারা বিনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি এখন ঘুমুতে যাও। যাবার আগে পায়েসের বাটি বদলে দিয়ে যাও। লাল বাটি দিতে বলেছিলাম না? কী বলি মন দিয়ে আগে শুনবে না? মানুষ তিনজন আর তুমি চারটা বাটি কেন বের করলে?
বিনু মোতাহার সাহেবের দূর সম্পর্কের ভাগ্নি। সে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা এসেছে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে এখনও ফিরে যাচ্ছে না। কারণ তার বাবা তাকে নিতে আসে নি। জাহানারা অত্যন্ত খুশি যে বিনুর ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া মানে প্রথম দেড় দুই বছর হলে সিট পাবে না। মেয়েটাকে এ বাড়িতে রাখতে হবে। নানান যন্ত্রণা। জাহানারা যন্ত্রণা পছন্দ করেন না। তাঁর ছিমছাম সংসার। এখানে যন্ত্রণার স্থান নেই।