তুমি যখন আগে থেকে জািন যে স্যাকারিন দেয়া হয়েছে তখনই বমি বমি ভাব হয়। না জানলে হয় না। যে দুদিন তোমাকে না জানিয়ে চিনির চা বলে স্যাকারিনের চা খাইয়েছি। তুমি কিছু বুঝতে পার নি।
মোতাহার সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলেন। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিলেন, এখন চোখ মেললেন। ঘরে আলো নেই ধললেই হয়। সবুজ তোয়ালে সব আলো চুষে নিয়েছে, তারপরও চোখ জ্বালা করছে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কই শুভ্ৰতো আসছে না?
পাখি নিয়ে এখনো বোধহয় খেলছে! ছেলেটা কী যে মজা পেয়েছে। একেবারে বাচ্চাদের স্বভাব। ডেকে নিয়ে আসি?
না থাক ডাকতে হবে না। আসুক নিজের মত করে। তুমি কি সত্যি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাও?
জাহানারা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই চাই। এ বাড়িতে একটা বউ আমার জন্যেও দরকার। তুমি থাক তোমার ব্যবসা নিয়ে, শুভ্র থাকে তার পড়াশোনা নিয়ে, আমার কে আছে বল? আমি থাকব কী নিয়ে? শুভ্রর বৌ থাকলে আমি যখন-তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারব। তাকে নিয়ে টুকটাক শপিং-এ যেতে পারব।
তা ঠিক।
আমি বউমাকে হাতে ধরে রান্নাও শেখাব। তারপর দুজনে মিলে রান্না করব। একটা আইটেম সে করল, একটা আইটেম করলাম। আমি। তোমরা খেয়ে বলবে কোনটা কে বেঁধেছে। কোনটা ফার্স্ট, কোনটা সেকেন্ড।
শুভ্ৰ কি বিয়ে করতে রাজি হবে?
কেন রাজি হবে না! তুমি বললেই রাজি হবে। আজই বল। আজ একটা শুভ দিন। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেব।
মোতাহার সাহেব প্রশ্ৰয়ের হাসি হাসলেন। জাহানারা বললেন, তুমি হাসবে না। আমি কিন্তু সিরিয়াস। ঘোমটাপরা লাজুক একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতেই কেমন লাগে।
আজকালকার মেয়েরা কি আর ঘোমটা দিয়ে ঘুরবে? লজ্জার ঘোমটা না, ফ্যাশানের ঘোমটা।
আমার ছেলের বউ ঘুরবে।
দরজায় টোকা পড়ছে। খোলা দরজা, শুভ্ৰ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে, তা সে করবে না। দরজায় টোকা দেবে। বাবার ঘরে ঢোকার আগে কোনো ছেলে কি টোকা দেয়?
শুভ্রর গলা শোনা গেল, বাবা আসব? মোতাহার সাহেব বললেন, আয়।
শুভ্র ঘরে ঢুকেই বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল।
মোতাহার সাহেব মুগ্ধ হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর গায়ের রঙ! মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। পাতলা ঠোঁট লালচে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব হালকা করে লিপষ্টিক দেয়া। মোতাহার সাহেব এবং জাহানারা দুজনেরই গায়ের রং ময়লা। তাদের বংশে কারোর কোঁকড়ানো চুল নেই। ছেলে এত সব সুন্দর সুন্দর জিনিস কোথেকে পেল? জাহানারা প্রায়ই বলেন, ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হত কত ভাল হত। আমি কত সুন্দর একটা মেয়ে পেতাম। তেমন সুন্দরী মেয়েতো আজকাল দেখাই যায় না। শুভ্ৰ যদি মেয়ে হত আমি তার নাম রাখতাম জুই। বিছানায় যখন শুয়ে থাকে তখন মনে হয় কেউ এক খলুই জুই ফুল ঢেলে রেখেছে। ছেলে হবার জন্য কঠিন একটা নাম রাখতে হল। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। শুভ্র! নামটা উচ্চারণ করার পর শেষ হয় না। মুখের ভেতর র র র করে কিছুক্ষণ বাজে।
মোতাহার সাহেব বলেছিলেন, ছেলের নাম টগর রাখলে কেমন হয়? টগার সাদা ফুল। নামের বানানও কঠিন না। যুক্তাক্ষর নেই।
জাহানারা ফুলের নামে ছেলের নাম রাখতে রাজি হলেন না। ফুলের নামে ছেলের নাম রাখলে সেই ছেলে মেয়েলি স্বভাবের হয়। সামান্য কিছুতেই খুনখুন করে কাঁদে। কথা বলার সময় মাথা কত করে রাখে। নাইন টেনে পড়ার সময় পাছা দুলিয়ে হাঁটা রপ্ত করে। ছিঃ।
শুভ্রর মধ্যে একটু বোধহয় মেয়েলি স্বভাব আছে। অতি সামান্য কারণে তার চোখ ছলছল করে। মাঝে মাঝে টপ করে চোখ থেকে পানি পড়েও যায়। যদিও শুভ্ৰ তার মাকে বলেছে- চোখ খারাপের জন্যে তার চোখে পানি জমে থাকে। জাহানারা ছেলের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। কত মানুষেরইতো চোখ খারাপ থাকে। তাদের সবার চোখ দিয়েই টপ টপ করে পানি পড়ে না-কি?
শুভ্র বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বসতে না বলা পর্যন্ত বসবে না। মোতাহার সাহেব বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন, চেয়ার টেনে বোস।
শুভ্ৰ চেয়ার টানল না। চেয়ার যেখানে রাখা ছিল সেখানে বসতে বসতে বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ?
মোতাহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ শরীরটা খারাপ। বেশ খারাপ। আজ অবশ্যি জ্বর এসেছে। জ্বর না এলেও বলতাম শরীর খারাপ।
শুভ্ৰ কিছু বলল না। মোতাহার সাহেব একটু মন খারাপ করলেন। কেউ যদি তার শরীর খারাপ বলে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাস করতে হয়- কী হয়েছে? অথচ শুভ্ৰ কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। চুপ করে চেয়ারে বসে আছে। জাহানারা বললেন, শুভ জন্মদিন শুভ্ৰ। তোর তেইশ বছর বয়স হয়ে গেছে কল্পনাই করা যায় না।
শুভ্ৰ মার দিকে তাকিয়ে হাসল। জাহানারা বললেন, একটু আগে তোর বাবার সঙ্গে কী নিয়ে কথা হচ্ছিল জানিস— তোর বিয়ে নিয়ে। আমরা দুজন মিলে ঠিক করেছি। তোর বিয়ে দিয়ে দেব। বাড়িতে বালিকা বধূ নিয়ে আসব। বউমাকে বলা থাকবে সে যেন সব সময় পায়ে নুপুর পরে থাকে। যেখানে যাবে ঝমঝম করে নুপূর বাজবে।
শুভ্র আবারো হাসল। এই হাসির মানে কী? যেহেতু শুভ্রর চোখ মোটা চশমার আড়ালে ঢাকা থাকে তার হাসির মানে বোঝা যায় না।
জাহানারা বললেন, তোর পছন্দের কেউ আছে? থাকলে বল।
শুভ্র বাবার দিকে ফিরে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, ময়না। কী খায় বাবা?
বিয়ের প্রসঙ্গে সে একবারও গেল না। হ্যাঁ না— কিছু না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে এল। মোতাহার সাহেব বললেন, ফলমূল খায়। কলা, আপেল, ধানও খায়। তবে কম। মাঝে মধ্যে শুকনো মরিচের বিচি খায়।