জাহানারা ছেলের পাশে বসলেন। তাঁর একটু মন খারাপ, কারণ শুভ্ৰ তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না— শুভ্রর যাবতীয় কৌতূহল ময়নাটার দিকে। শুভ্র বলল, ময়নাটা আর কোনো কথা জানে না?
আমি তো একটা কথাই বারবার শুনছি।
কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? একটা পাখি অবিকল মানুষের গলায় কথা বলছে।
শুভ্ৰর কথার মাঝখানে পাখি বলল—
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ বিক্ষিত গলায় বলল, শুভ্রর মত যুক্তাক্ষর কত স্পষ্ট করে বলছে দেখছ মা? কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে না। একজন আমেরিকান বা বিলেতী সাহেব দু তিন বছর চেষ্টা চরিত্র করার পরও শুভ্র বলতে পারবে না। বলবে সুবরু।
জাহানারা বললেন, তোর পাখি সাহেবদের চেয়েও সুন্দর করে শুভ্র বলছে ঠিকই, কিন্তু খাইছ শুনতে বিশ্ৰী লাগছে না? তোর বাবা ইচ্ছা করলেই খাইছ না শিখিয়ে খেয়েছো শেখাতে পারত। তোর বাবার গ্রাম্যতা দূর হল না। ময়না যখন কথা বলে তখন মনে হয়। কাজের বুয়া কথা বলছে। সুন্দর কিছু শিখাবে— তা না।
শুভ্র বলল, ভাত খাইছাঁ শুনতে আমার কাছে খারাপ লাগছে না। মিথ্যা করে হলেও মনে হচ্ছে পাখিটা আমার ব্যাপারে কনসার্ন। আমি ভাত খেয়েছি। কিনা তা জানতে চায়।
তোর বাবাকে থ্যাংকস দিবি না?
বাবা কি জেগে আছেন?
হ্যাঁ জেগে আছে। তোকে হ্যাপী বাৰ্থ ডে বলার জন্যে জেগে আছে। তার শরীরটা অবশ্যি খারাপ। জ্বর এসেছে। ঘুমিয়ে পড়লে ভাল করত।
বাবাকে ঘুমিয়ে পড়তে বল মা। আমি সকালে থ্যাংকস দেব।
তোর জন্যে জেগে বসে আছে- তুই সকালে থ্যাংকস দিবি এটা কেমন কথা? অসুস্থ একজন মানুষ। অপেক্ষা করে আছে। আর আমি নিজেও তো তোর জন্যে কাওনের চালের পায়েস বানিয়েছি। আয় সবাই মিলে পায়েস খাব। তুই আমাদের পা ছুঁয়ে কদম্বুসি করে দোয়া নিবি না?
তুমি যাও। আমি আসছি। তবে পায়েস খাব না। আর কদমবুসিও করতে পারব না। লজ্জা লাগে।
শুভ্ৰ গভীর আগ্রহের সঙ্গে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিটার কী সুন্দর, চকচকে কালো গা। যেন গা থেকে কালো আলো বের হচ্ছে। শুভ্র নিজের মনেই হাসল— ফালো আলো আবার কী? আলো কখনো কালো হয় না। পাখিটাকে মজার কিছু শেখাতে হবে। অদ্ভুত কিছু। যেন পাখির কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। এক লাইন গান শেখালে কেমন হয়?
বধূ কোন আলো লাগল চোখে।
যে পাখি শুভ্ৰ ভাত খাইছ বলতে পারে সে নিশ্চয় বিধু কোন আলো লাগল চোখেও বলতে পারবে। কিংবা আরেকটা জিনিস শেখানো যায়— খিলখিল হাসি। পাখিটা একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠবে। শুভ্রর পরিচিত মানুষদের মধ্যে সবচে সুন্দর করে হাসে মীরা। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে মীরার হাসি রেকর্ড করে নিয়ে এলে হয়। রেকর্ড করা হাসি বার বার পাখিকে শুনানো হবে। মীরাকে আগে বলা যাবে না কেন তার হাঁসি রেকর্ড করা হচ্ছে। একদিন তার হাঁসি তাকে ফেরত দিয়ে চমকে দেয়া যাবে।
শুভ্ৰর বাবা মোতাহার সাহেবের শরীর কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। তাঁর ডায়াবেটিস আছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এসিডিটি। মানুষের শরীরে কোনো রোগ একা বাস করতে পারে না। কিছুদিনের মধ্যেই সে তার সঙ্গি জুটিয়ে ফেলে। যার ডায়াবেটিস আছে তাকে ধরে এজমায়।
মোতাহার সাহেব নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন। সকালে নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটেন। দুপুরে চায়ের কাপে এক কাপ ভাতের বেশি। কখনো খান না। তারপরেও রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে বলছে। ইনজেকশনের ব্যাপারে মোতাহার সাহেবের সীমাহীন ভীতি আছে। রোজ ইনজেকশন নিতে হবে- এই ভয়েই তিনি কাতর হয়ে আছেন।
আজ তাঁর জ্বর এসেছে। তেমন কিছু না, নাইনটি নাইন পয়েন্ট ফাইভ। পঞ্চাশ বছর বয়সে এই জুরাই মানুষকে কাহিল করে দেয়। সন্ধ্যার দিকে মনে হচ্ছিল তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক ভার, নিঃশ্বাসে কষ্ট। সেই যন্ত্রণা এখন নেই। শুধু মাথা ভার ভার হয়ে আছে এবং চোখ জ্বালা করছে।
তিনি খাটে চাঁদর গায়ে শুয়ে আছেন। ঘর ঠাণ্ডা, এসি চলছে। খাটের পাশে টেবিল ল্যাম্প জুলছে। আলো চোখে লাগে বলে টেবিল ল্যাম্পের ওপর একটা টাওয়েল দেয়া আছে। টাওয়েলের রঙ সবুজ বলেই ঘৱে কেমন সবুজ সবুজ আলো। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন, জাহানারা ঘরে ঢোকার পরেও চোখ না মেলেই বললেন, শুভ্ৰ খুশি হয়েছে?
জাহানারা বললেন, খুশি মানে। বাচ্চাদের মত খুশি। খাচার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। এখনই তোমাকে থ্যাংকস দিতে আসবে।
থ্যাংকসের কী আছে? জন্মদিনের সামান্য উপহার।
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, সামান্য উপহার? তুমি কলমাকান্দা থেকে পাখি আনিয়েছ। অফিসে তিন মাস রেখে কথা শিখিয়েছ। এটা সামান্য হল? বাংলাদেশের কটা বাবা এরকম করে?
শুভ্ৰর বয়স কত হল?
তেইশ। আচ্ছা শোন, আমি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাই।
মাত্র তেইশ বছর বয়স, এখনই কীসের বিয়ে?
তুমি নিজে কিন্তু তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে?
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আমি শুভ্ৰকে এখনই বিয়ে দেব। ওর জন্যে শক্ত টাইপের একটা মেয়ে দরকার। শুভ্র হচ্ছে লতানো গাছ, ওরা দরকার শক্ত খুঁটি। তা ঠিক। জাহানারা একটু পান দাও তো, পান খাই।
পান পরে খাও। শুভ্ৰ আসুক, আমরা আগে এক সঙ্গে পায়েস খাব। তোমার জন্যে আলাদা করে স্যাকারিন দিয়ে পায়েস বানিয়েছি।
স্যাকারিন মিষ্টিটা আমার শরীরে সহ্য হয় না। খেলেই বমি বমি ভাব হয়।