জাহানারা বললেন, ছাব্বিশ বছর। কেন জিজ্ঞেস করছিস?
এমনি।
মার মানসিক অবস্থা শুভ্ৰ চিন্তা করতে চেষ্টা করছে। একজন মানুষের সঙ্গে ছাব্বিশ বছর কাটানোর পরে এই মহিলার আজ কেমন লাগছে? খুব কষ্টতে লাগছেই – সেই কষ্টের সঙ্গে কি সামান্য আনন্দও নেই? মুক্তির আনন্দ। এই মহিলা আজ রাতে যখন ঘুমুতে যাবেন তখন একটু কি ভাল লাগবে না। এই ভেবে যে তাঁকে এখন আর সারাক্ষণ সাবধান থাকতে হবে না। পাশের মানুষটার ঘুম ভেঙ্গে গেল কি গেল না তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে না। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে পারবেন। রাত-দুপুরে বাতি জ্বালালে কেউ বলবে না— এ-কী বাতি নেভাও। চোখে আলো লাগছে। সব আনন্দের সঙ্গে যেমন কষ্ট মিশে থাকে- সব কষ্টের মধ্যেও তেমনি কিছু আনন্দ থাক।
বিনু চা নিয়ে এসেছে। জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, চা এনেছ কেন? আজ আমার চা-কফি খাওয়ার দিন?
শুভ্র বলল, খাও মা! ভাল লাগবে।
জাহানারা চায়ের কাপ হাতে নিলেন। বিনুর দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলেন চলে যেতে। বিনু চলে গেল। শুভ্ৰ বলল, বাবার মধ্যে সবচে ভাল জিনিস কী ছিল মা?
জাহানারা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, রাগ এক বস্তু তাঁর মধ্যে ছিল না। কখনো রাগ করত না। তাঁকে কেউ উঁচু গলায় কথা বলতে শুনে নি।
এটাতো কোনো ভাল ব্যাপার না মা। যে মানুষ রাগ করে না সে তো রোবট। আমি নিজেও রাগ করি না। কিন্তু আমি এটাকে কোনো গুণ বলে মনে করি না। বাবার মধ্যে ভাল আর কী আছে?
জাহানারা জবাব দিচ্ছেন না। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। শুভ্রর মনে হল, মা ভাল কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাড়ির সামনে একটী বেবীটেক্সি এসে থেমেছে।
বেবীটেক্সি থেকে ম্যানেজার ছালেহ নামছেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গভীর। চোখ লাল এবং ফোলা ফেলা। মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছেন। পুরুষ মানুষ সামান্য কাঁদলেই চোখ ফুলে যায়। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে হঠাৎ করে তাঁর বয়সও বেড়ে গেছে। হাঁটছেন কুঁজো হয়ে।
লোকজন আসতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে। শুভ্ৰ চায়ের কাপ হাতে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। মৃত বাড়িতে কে কীভাবে ঢুকবে তার দেখতে ইচ্ছা করছে। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে ঢুকবে। কারো কান্না হবে মেকি। কারো কান্না হবে। আসল। আসল এবং মেকি কান্নার ভেতর প্রভেদ করা কি যাবে? না, যাবে না। এ রকম কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে দুঃখের কান্নায় অশ্রু হবে হালকা নীল রঙের তাহলে ভাল হত। চোখের জলের রঙ দেখে আসল দুঃখ না বানানো দুঃখ বোঝা যেত।
কাপের চা শেষ হয়ে গেছে। শুভ্ৰ খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছে। সে চোখের জলের রঙ নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। তার বাবার মৃত দেহ বিছানায় পড়ে আছে। সে এখনো তাঁকে দেখতে যায় নি। সে নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাবছে। তবে তার জন্যে সে লজ্জিত বোধ করছে না। কারণ সে জানে প্রবল শোকের সময় মস্তিষ্ক শোক তুলিয়ে রাখার জন্যে নানান উদ্ভট কাণ্ড কারখানা করে। চোখের জলের রঙ নিয়ে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মস্তিষ্ক তাকে দিয়ে করাচ্ছে।
গভীর দুঃখের চোখের জলের রঙ : গাঢ় নীল
মোটামুটি ধরনের দুঃখের অশ্রুজল : হালকা নীল
শারীরিক ব্যথার অশ্রদ্ধ : কালো
আনন্দের অশ্রু : গোলাপি
চিন্তা নিয়ে বেশি দূত্র আগানো গেল না। ম্যানেজার সাহেব শুভ্রর পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন— ছোট বাবু, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
শুভ্ৰ বলল, কী কথা?
তোমার ঘরে চল। নিরিবিলিতে বলি।
শুভ্রর বারান্দা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। আরো দুটা বেবীটেক্সি এসে থেমেছে। গাড়ি এসে থেমেছে। লোকজন নামছে। এদের সবার মুখের দিকে সে আলাদা করে তাকাতে চায়। বেশির ভাগ মানুষকেই সে চেনে না। গাড়ি থেকে বৃদ্ধ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে উনিশ কুড়ি বছরের দুটা মেয়ে নেমেছে। দুজনই খুব হাসছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাদের কী যেন বললেন। তারা হাসি থামিয়ে ঘরে ঢুকছে। মেয়ে দুটির হাসি দেখতে ভাল লাগছিল।
ছালেহ গম্ভীর গলায় বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। এসো আমার সঙ্গে।
শুভ্ৰ নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বারান্দা থেকে ঘিরে এল।
ম্যানেজার সাহেব বসেছেন চেয়ারে। শুত্র বসেছে তাঁর সামনের খাটে। ছালেহ সরাসরি শুভ্ৰর চোখের দিকে তাকালেন। শুভ্ৰর কাছে মনে হল— ভদ্রলোক খানিকটা বিরক্ত। এই বিরক্তির কারণটা কী— শুভ্র ধরতে পারছে না।
ছোট বাবু!
জ্বি।
খুবই দুঃজনক ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনার উপর আমাদের হাত নাই।
জ্বি।
এখন ঠাণ্ডা মাথায় বাকি কাজগুলি করতে হবে। মৃত্যুর পর স্যারকে কোথায় কবর দেয়া হবে এই সম্পর্কে স্যার কি কিছু বলে গেছেন?
জ্বি না।
কোথায় কবর দিতে চাও?
এই সম্পর্কে কিছু ভাবি নি।
তোমার আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে; কারণ দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। আজ আবার ছুটির দিন।
ছুটির দিনে নিশ্চয়ই কবরস্থান বন্ধ থাকে না?
কবরস্থান বন্ধ থাকে না। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ থাকে। সব কিছুতেই টাকা লাগে। জন্মের সময় টাকা লাগে। মৃত্যুর সময়ও টাকা লাগে।
তা ঠিক।
টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। স্যার টাকা তুলে রেখে গেছেন। আমার কাছে টাকা আছে।
তাহলেতো ভালই।
স্যারের সমস্ত একাউন্ট— জয়েন্ট একাউন্ট। তোমার সঙ্গে জয়েন্ট একাউন্ট। তুমি ইচ্ছা করলেই টাকা তুলতে পারবে।