খবরটা শুভ্ৰকে দিতে হবে। কীভাবে দেবেন। শুভ্ৰই বা খবর শুনে কী করবে? চিৎকার করে কেঁদে উঠবে? কেঁদে উঠবে তো অবশ্যই। কিন্তু তাঁর নিজের কান্না আসছে না কেন?
দরজার কাছে বিনু দাঁড়িয়ে আছে। সকালের নরম আলোয় সব কিছুই দেখতে সুন্দর লাগে। বিনুকেও দেখতে সুন্দর লাগছে; শুভ্রর মনে হল বিনু গোসল করেছে। মেয়েরা গোসল করলেই তাদের চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধতা চলে আসে। শুভ্র স্বাভাবিক গলায় বলল, বিনু তুমি কি গোসল করেছ?
বিনু বলল, না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র গোসল করলে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসে বোস।
বিনু ভেতরে ঢুকল না। বিনুর খুবই অবাক লাগছে— এই মানুষটা কিছুক্ষণ আগে তার বাবা মারা যাবার খবর শুনেছে। চিৎকার করে কাদছে না, হৈচৈ করছে না। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। কথা বলছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
বিনু!
জ্বি।
চা খেতে ইচ্ছা করছে। চা খাওয়াতে পারবে?
বিনু কিছু বলল না। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্ৰ বলল, আচ্ছা বিনু আমার আচরণ কি তোমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগছে। বাবা মারা গেছেন এই খবর শোনার পরও চুপ করে বসে আছি। এখনও তাকে দেখতে যাই নি। সতি্যু করে বল, তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে?
লাগছে।
আমার নিজের কাছে কিন্তু লাগছে না। বড় ধরনের দুঃখ বা বড় ধরনের আনন্দ মানুষ নিতে পারে না। বড় ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হলে মানুষ রবোটিক আচরণ করে। আমি রুবোটিক আচরণ করছি। তার মানে এই না যে আমি বাবাকে ভালবাসি না।
খাচার ভেতর ময়নাটা খচমচ করছে। শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে ময়নাটার দিকে। আজ সারাদিন এ বাড়িতে অনেক ঝামেলা যাবে। ঝামেলার ভেতর ময়নাটাকে হয়ত খাওয়া দিতে ভুলে যাবে। সেও কাউকে মনে করিয়ে দিতে পারবে না— যে ময়নাকে খাবার দেয়া হয় নি।
বিনু!
জ্বি।
ময়নাটাকে খাবার দেয়ার ব্যাপারটা তুমি আজ খেয়াল রেখো। মৃত মানুষের বাড়ি হল নানান ঝামেলার বাড়ি। ময়নাকে খাবার দেবার কথা হয়ত কারোর মনেই থাকবে না।
আমি লক্ষ রাখব।
মা কোথায় জান?
বারান্দায়। ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন।
আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেয়া হয়ছে কি-না জান?
এখনো খবর দেয়া হয় নি। ম্যানেজার সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। উনি এসে সবাইকে খবর দেবেন।
ও আচ্ছা।
আমার এক চাচা থাকেন দেশের বাইরে। তাকেও যেন খবর দেয়া হয়। ম্যানেজার সাহেবকে মনে করিয়ে দিও!
জ্বি দেব।
মানুষের জন্ম-সংবাদ যেমন সবাইকে দিতে হয়; মৃত্যু-সংবাদও দিতে হয়।
বিনু বলল, আপনি উঠে হাত মুখ ধোন। আমি চা নিয়ে আসছি।
হঠাৎ করেই ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। শুভ্র চমকে উঠে বলল, কে কাঁদছে?
বিনু বলল, বুয়া কাঁদছে।
শুভ্ৰ অবাক হয় বলল, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। বাবা মারা গেছেন, অথচ আমি কাঁদছি না, মা কাঁদছেন না— কাঁদছে কাজের মেয়েটা। মেয়েটা এসেছে মাত্র গতকাল।
বিনু বলল, সে দায়িত্ব মনে করে কাঁদছে। আপনি কাঁদবেন। দুঃখে।
আমারটা বাদ দাও। মা কেন কাঁদছে না এটাই আমার প্রশ্ন! তুমি কি জান মা কেন কাঁদছে না?
আপনি চাচির সামনে দাঁড়ালেই উনি কাঁদতে শুরু করবেন। তার আগে না।
আমি সামনে না যাওয়া পর্যন্ত মা কান্দবে না?
না।
আর আমি, আমি কখন কাঁদব?
আপনি কাঁদবেন অনেক দিন পর।
শুভ্ৰ বিছানা থেকে নামল। ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। বিনুর কথা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। তাকে দেখে মা কাঁদতে শুরু করবে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সে কাঁদবে না, এটা ঠিক না। মাকে কাঁদতে দেখেই তার চোখে পানি আসবে।
জাহানারা চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। একটু আগে মাথায় পানি দিয়ে এসেছেন বলে তার মাথা ভেজা। শাড়িও ভেজা। ভেজা শাড়ি মাথায় দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। তাকে ঘিউ বউ লাগছে। শুভ্ৰকে দেখেই তিনি চিৎকার করে। কেঁদে উঠলেন। শুভ্র এগিয়ে গিয়ে মার হাত ধরল। জাহানারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। কিন্তু শুভ্রর চোখ একটু ছলছল পর্যন্ত করছে না। তার খুবই লজ্জা লাগছে। তার মনে হচ্ছে এই অস্বাভাবিক দৃশ্যটা তার বাবাও দেখছেন। শুভ্র লজ্জা পাচ্ছে দেখে তিনি সান্তুনা দিতে চেষ্টা করছেন। তিনি যেন বলছেন সব মানুষ কি এক রকম হয়? তুই একটু আলাদা। আলাদা হবার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। চোখে পানি আসছে না। তাতে কী হয়েছে। চোখের পানি এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তুই হলি অন্যরকম। আলাদা।
আলাদা হবার মধ্যে যেমন লজ্জার কিছু নেই তেমন আনন্দেরও কিছু নেই। যারা আলাদা তাদের সবাই অন্য চোখে দেখে। খুব যারা আলাদা তাদের রেখে দেয়া হয় পাগলা গারদে।
বিনু চা নিয়ে এসেছে। জাহানারা বিনুর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, এই অবস্থায় তুমি চা নাশতা নিয়ে এসেছ? তোমার কাণ্ডজ্ঞান কোনোদিন হবে না?
শুভ্র বলল, মা আমি চা চেয়েছি। ও নিজে থেকে আনে নি।
জাহানারা চট করে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, আমাকে ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি দাও।
বিনু শান্ত গলায় বলল, আপনাকেও চা দেই! কড়া এক কাপ চা খেলে ভাল লাগবে।
জাহানারা হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। বিনু চা আনতে গেল।
আশ্চর্যের ব্যাপার। আজকের চা অসাধারণ হয়েছে। শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। সব দিনের চা এমন হয় না। কোনোদিন লিকার বেশি থাকে, কোনোদিন চিনি কম হয়। আবার কোনোদিন সবই ঠিক আছে কিন্তু হয় ঠাণ্ডা।
শুভ্ৰ হঠাৎ বলল, মা, তোমার বিয়ে হয়েছে কত দিন?