পড়াশোনার পর্ব শেষ করার পরের অংশ হল বারান্দা। বারান্দায় সে এক ঘণ্টা থাকবে। এই এক ঘণ্টায় সকাল হতে শুরু করবে। সকাল দেখাটা মন্দ না। অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পর্বটা এত সুন্দরভাবে হয় যে শুভ্ৰ প্ৰতিবারই মুগ্ধ হয়। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, একটা সকালের সঙ্গে আরেকটা সকালের কোনোই মিল নেই। প্রতিটি সকালেই আলাদা।
সকাল হওয়া দেখে শুভ্ৰ আবারো বাথরুমে যায়। হাত, মুখ ধোয়। আবারো দাঁত ব্ৰাশ করে। তারপর পাতলা চাঁদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুম আসতে তখন আর দেরি হয় না।
আজ শুভ্রর ঘুম ভাঙল তিনটার অনেক আগে। সে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব। রাত বাজছে বারোটা দশ। সে ঘুমুতে গেছে। দশটা চল্লিশে। অর্থাৎ সে মাত্র দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেল। কারণটা কী? শরীরের ভেতরের এলার্ম ক্লাকে কি কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? যিনি এলার্ম ক্লাকে চাবি দেন সেই তিনি চাবি দিতে ভুলে গেছেন? শুভ্ৰ বিছানা থেকে নামল আর তখনি শুনল খুব স্পষ্ট গলায় কে যেন ক্রমাগত বলছে
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
গলার স্বরটা অনেকটাই তার বাবার মতো; একটু শুধু চিকন। শব্দটা আসছে। তার ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। বাবা কি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন? তার পুত্ৰ ভাত খেয়েছে কি-না জানতে চাচ্ছেন? তা কী করে হয়! শুভ্ৰ বিস্মিত গলায় বলল, কে?
দরজার ওপাশের শব্দ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। ভৌতিক কিছু? না-কি হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারণে শুভ্ৰীয় মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, হেলুসিনেশন হচ্ছে। শব্দের হেলুসিনেশন। শরীরে হঠাৎ করে অক্সিজেনের অভাব হলে হেলুসিনেশন হয়। দরজা জানালা বন্ধ করে শোয়ায় কি অক্সিজেনের ঘাটতি হল? তা হবার কথা না। শুভ্র বাথরুমে ঢুকল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আবারো সেই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা—
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ মা বলে আতংকিত শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিয়ে শুভ্ৰর মা জাহানারা বললেন, ও খোকন আমি এখানে, ভয় পেয়েছিস? দরজা খোল। শুভ্র হড়বড় করে বলল, মা, কে যেন কথা বলছে। জাহানারা বললেন, দরজাটা খোল খোকন। আমি ভয় ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি।
শুভ্র দরজা খুলছে না। বিড়বিড় করছে। অস্পষ্টভাবে সে মাকে ডাকছে। তার পা কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। জাহানারা ব্যাকুল গলায় বললেন, ও খোকন ভয়ের কিছু নেই। এটা একটা ময়না পাখি। তোর বাবা এনেছে। দরজা খোল বোকা।
দরজা খুলে শুভ্ৰ বের হয়ে মাকে দেখল। খাচা হাতে তিনিই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে প্ৰচণ্ড ভয় পেয়েছে এই জন্যে তিনি খুবই বিব্রত। জাহানারা বললেন, এত ভয় পেয়েছিস কেনরে বোকা? ইশ মুখ টুখ শুকিয়ে কী হয়েছে! এই দেখি ময়না। কথা বলা ময়না। ময়না কথা বলছিল।
শুভ্ৰ ময়নার দিকে তাকালো। ময়না যন্ত্রের মত বলল–
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
জাহানারা ছেলের হাত ধরলেন। এবং কপালের উত্তাপ পরীক্ষা করলেন। ভয়ে ছেলের জ্বর এসে যায়নিতো? জ্বর দেখার কাজটা তিনি সব সময় করেন। জ্বর থাকলেও করেন, না থাকলেও করেন। অনেক দিনের অভ্যাস থেকে এরকম হয়েছে। ছোটবেলায় শুভ্রর হঠাৎ করে জ্বর আসত। ছেলে দিব্যি নিজের মনে হাসছে খেলছে- কপালে হাত দিলেই দেখা যেত আকাশ-পাতাল জ্বর।
জাহানারা কোমল গলায় বললেন, খুব ভয় পেয়েছিলি?
শুভ্ৰ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বাড়াবাড়ি রকমের ভয় পাওয়ায় তার একটু লজার মত লাগছে।
জাহানারা বললেন, তুই কি ভেবেছিলি ভূত?
কিছু ভাবি নি। তবে ভয় পেয়েছি।
তোর বাবা তিন মাস আগে ময়নাটা কিনেছে। অফিসে রেখে কথা শিখিয়েছে। আমাকে বলেছে ঠিক যেন বারোটা এক মিনিটে পাখিটা নিয়ে তোর দরজার সামনে দাঁড়াই। আমি তাই করলাম। তুই এত ভয় পাবি বুঝতে পারি নি।
শুভ্র ময়নার খাঁচার সামনে বসে পড়েছে। পাখিটা অবিকল তার বাবার গলায় কথা বলছে। কী বিস্ময়কর ঘটনা! জীবন্ত ভয়েস রেকর্ডার।
খোকন।
উঁ।
ময়না পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হয় নি। খাঁচায় বন্দি পাখি দেখতে খারাপ লাগে, তবে খুব অদ্ভুত লাগছে- মা, ময়না পাখি কি যা শুনে তাই বলতে পারে?
হ্যাঁ পারে। তুই মজার মজার কথা শিখাবি– ও সুন্দর করে বলবে।
আমি শুধু Talking bird-এর কথা শুনেছি, এই প্রথম ওদেরকে কথা বলতে শুনলাম। ব্যাপারটা যে এত ইন্টারেস্টিং হবে জানতাম না। বাবার গলাটাতো খুব সুন্দর নকল করেছে।
তুই খুশি হয়েছিস শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, খুশি হব কেন?
তোর একটা শখের জিনিস তোর বাবা তোকে প্রেজেন্ট করল। এই জন্যে।
হ্যাঁ খুশি হয়েছি।
জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে রহস্যপূর্ণ গলায় বললেন, খোকন বলত ঠিক বারোটা এক মিনিটে তোর ঘরের দরজার সামনে কেন দাঁড়িয়েছিলাম? দেখি তুই বলতে পারিস কি-না।
শুভ্র কারণটা জানে। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে মা রাত কারোটায়। এই ধরনের ছেলেমানুষী করেন। বাবারও তাতে সায় থাকে। শুভ্ৰ মার দিকে তাকাল। জাহানারায় চোখ চকচক করছে। শুভ্ৰ জানে মা জন্মদিনের খবরটা দিয়ে তাকে চমকে দিতে চাচ্ছেন। মাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। জাহানারা আবার বললেন, কীরে জিনিস, কেন রাত বারোটা এক মিনিট তোর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?
জানি না।
আরে বোকারাম আজ তোর জন্মদিন। আচ্ছা তুই সব সময় নিজের জন্মদিন ভুলে যাস কেন? গতবারও ভুলে গেলি। তোর সব কিছু মনে থাকে। আর জন্মদিন মনে থাকে না? অন্যদিন রাত এগারোটার সময় ঘুমুতে যাস আজ ঘুমুতে গেলি সাড়ে দশটায়।