ভাই পাগলা পীর সাহেব মজার মজার কথা বলেন। দোজখের প্রসঙ্গে বলতেন— দূর ব্যাটা। দোজখের আগুন দোজখের আগুন। সব দোজখে আগুন আছে না-কি? আগুন নাই এমন দোজখও আছে। ঠাণ্ডী দোজখ। বড়ই ঠাণ্ডা। সেই দোজখের নাম জাহীম। বড়ই ভয়ংকর সেই ঠাণ্ডা দোজখ। জাহিম দোজখবাসী চিৎকার কইরা কী বলে জানস? বলে ওগো দয়াল আল্লা। দয়া করি আমারে কোনো আগুনের দোজখে নিয়া পুড়াও ।
মোতাহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে ভাই পাগলা পীর বলেছিলেন- দোজখের নামগুলি মুখস্ত করে রাখ, তুইতো সেইখানেই যাবি। হি-হি হি। আশ্চর্যের ব্যাপার সাতটা দোজখের নাম তাঁর ঠিকই জানা–জাহান্নাম, হাবিয়া, সাক্কার, হুতমাহ, সায়ীর, জাহীম, লাজা।
বেহেশতের নামগুলির মধ্যের শুধু দুটার নাম জানেন- জান্নাতুল ফেরদাউস এবং জান্নাতুল মাওয়া।
মোতাহার সাহেবের উপর আরেকটা ভারী পাথর চাপানো হয়েছে। এই পাথর আগেরটার মত না। এর ওজন বাড়ে কমে। যখন কমে তখন মনে হয়— ওজনহীন একটা পাথর বুকে নিয়ে থাকা কতই না আনন্দের।
মোতাহার সাহেব লক্ষ করলেন জাহানারা ঘরে ঢুকছেন। জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে কফির মগ। শোবার আগে তিনি মগ ভর্তি কফি খান। এই অভ্যাস আগে ছিল না। কোন পত্রিকায় পড়েছেন যাদের অনিদ্রা রোগ আছে, শোবার আগে কফি খেলে তাদের সুনিদ্রা হয়। জাহানারার অনিদ্রা রোগ আছে। মােতাহার সাহেবের মনে হল তাঁর মৃত্যুর পর জাহানারার অনিদ্রা রোগ সেরে যাবে। বিছানায় যাবার আগে তাকে গোসল করতে হবে না। তিনটা চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে না, মগ ভর্তি কফি খেতে হবে না।
কফির গন্ধ মোতাহার সাহেবের নাকে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রবল কষ্টের মধ্যেও গন্ধটা ভাল লাগছে। ইশ এখন যদি সহজ স্বাভাবিক মানুষের মত এক মগ কফি হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরানো যেত। ভাই পাগলা পীর সাহেবকে একদিন কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল— হুজ্বর বেহেশতে কি সিগারেট আছে? পীর সাহেব বললেন, আছে। দশ ফুটি সিগারেট। এক এক শলা দশ ফুট লম্বা। তবে বেহেশতে আগুন নাইতো। এই কারণে সিগারেট ধরানো যাবে না। সিগারেট ধরানোর জন্যে যাওয়া লাগবে দোজখে। হিহিহি।
মোতাহার সাহেব গভীর বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। কফির কাপ নিয়ে ঘরের ভেতর হাঁটছে জাহানারা। বুঝতেও পারছে না, কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। একবার সে যদি তাঁর দিকে তাকাতো তাহলেই বুঝতে পারতো। সে তাকাচ্ছে না। মোতাহার সাহেব স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কিছু করতে পারছেন না। না, জাহানারার দোষ নেই। তিনি আছেন মশারির ভেতর। জাহানারা তাকে দেখতে পারছে না। অথচ তিনি জাহানারীকে দেখতে পারছেন। জাহানারার বিছানায় আসতে অনেক সময় লাগবে। সে তার কফি শেষ করবে, তারপর তার ভেজা চুল হেয়ার দ্রায়ারে শুকাবে! এই কাজটা সে করবে। অন্য ঘরে যাতে হেয়ার ড্রায়ারের শব্দে তাঁর ঘুম না ভাঙ্গে; এইতো জাহানারা চলে যাচ্ছে। মোতাহার সাহেব প্ৰাণপণে ডাকলেন- জাহানারা। জাহানারা। না গলায় স্বর নেই। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না।
পায়ের কাছের মশারিটা কে যেন তুলছে। অপরিচিত একজন মানুষের মুখ। মোতাহার সাহেব আতংকে অস্থির হলেন। মশারির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে কে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে? মাথার কাছের মশারিটা এখন উঁচু হচ্ছে। আরেকজন কেউ মাথা বের করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এইতো আরেকটা মুখ দেখা যাচ্ছে। এই মুখটাও অচেনা। দুজনই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাদের দৃষ্টিতে ভালবাসা নেই, মমতা নেই, করুণা নেই। পায়ের ডানপাশের মশারি উঁচু হচ্ছে— তৃতীয় একজনের মাথা দেখা যাচ্ছে। মোতাহার সাহেব চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। তাও পারলেন না।
আতংক এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন তার চারপাশের অসংখ্য মুখের দিকে। এদের সবাইকেই তিনি এক সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন এটাও একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। হেয়ার ড্রায়ারের একঘেয়ে শব্দ তাঁর কানে আসছে। শব্দটা কী কুৎসিত! কী কুৎসিত! একটা মশা ঠিক তাঁর চোখের সামনে এসে উড়ছে। মশারও চোখ আছে। সেই চোখ টানা টানা- মনে হয় কাজল পরানো। মোতাহার সাহেব এই তথ্য আজ প্রথম জানলেন। মশােটা তার চোখের মণির ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করছে। মোতাহার সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে গভীর অতলে তলিয়ে গেলেন।
মোতাহার সাহেব মারা গেছেন। এই ব্যাপারটা ধরা পড়ল সকালে। জাহানারা না, কাজের মেয়ে চা নিয়ে ডাকতে এসে হতভম্ব গলায় বলল, খালুজানের কী হইছে?
জাহানারা বাথরুম থেকে বললেন, চায়ের কাপ পিরিচ দিয়ে ঢেকে রেখে চলে যা। চিৎকার করে ঘুম ভাঙবি না।
কাজের মেয়ে তখন হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে বিকট চিৎকার করল। জাহানারা ভেজা শরীরে বাথরুম থেকে বের হলেন। মোতাহার সাহেবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। মানুষটা এখন মারা যায় নি। অনেক আগেই মারা গেছে। তিনি সারা রাত মৃত মানুষটাকে পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন। রাতে জাহানারার ভাল ঘুম হয় না, কিন্তু কাল রাতে তাঁর সুনিদ্রা হয়ছে। শেষ রাতে বৃষ্টি নেমে ঘর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। তিনি পায়ের কাছে রাখা পাতলা চাঁদর গায়ে দিয়েছেন। শুধু নিজের গায়েই দেন নি। স্বামীর গায়েও তুলে দিয়েছেন। একজন মৃত মানুষের সঙ্গে একটা চাঁদরের নিচে রাত কাটিয়েছেন। কী ভয়ংকর কথা! জাহানারার শরীর যেন কী রকম করছে। পেটের কাছে পাক দিচ্ছে। তিনি ছুটে গিয়ে বেসিন ভর্তি করে বমি করলেন। কী ভয়ংকর বমি। মনে হচ্ছে পাকস্থলী উঠে আসছে। বিনু ছুটে এসে তাকে ধরেছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ভয়ে তাঁর শরীর কাঁপছে। শুভ্ৰর বাবা মারা গেছেন তার জন্যে ভয় না। এক চাঁদরের নিচে একজন মৃত মানুষকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন সেই কারণে ভয়। ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না।