শুভ্র বলল, ও।
ভাত খায় নি, শুয়ে পড়েছে।
উপোস অসুখের জন্যে ভাল মা। উপোসী মানুষের অসুখবিসুখ খুব কম হয়।
কে বলেছে?
কেউ বলে নি। আমি ভেবে ভেবে বের করেছি। মুনী ঋষিদের অসুখ বিসুখ হয় না। কারণ তারা বেশির ভাগ সময়ই উপোস থাকেন। খেলেও একবেলা খান। আবার ভিক্ষুকরাও তেমন খেতে পায় না বলে ওদের অসুখ বিসুখ হয় না।
ভিক্ষুকদের অসুখ বিসুখ হয় না, তোকে কে বলল?
আমার মনে হয়। আমার ধারণা সব ভিক্ষুক শরীরের দিক দিয়ে খুব ফিট। সারাদিন হাঁটাহাটি করেতো ভাল একসারসাইজ হয়।
ভিক্ষুকদের ব্যাপারে তুই মনে হয়। অনেক কিছু জেনে ফেলেছিস।
শুভ্ৰ মার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, মা বলতো দেখি আমরা সবচে বেশি ক্ষমা চাই কাদের কাছে।
জাহানারা ভুরু কুঁচকে বললেন, ক্ষমা চাইব কেন। ক্ষমা চাইবার মত অপরাধ কী করলাম?
অপরাধ না করেও ক্ষমা চাও। বলা দেখি কার কাছে।
আল্লাহর কাছে?
হয় নি ভিক্ষুকদের কাছে – দিনের মধ্যে অনেকবার তোমাকে বলতে হয়— মাফ কর। ভিক্ষা নাই। তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর ভিক্ষুকদের কাছে তাই না?
জাহানারা চুপ করে আছেন। শুভ্ৰ হাসছে। সে ক্যাসেট প্লেয়ার আবার চালু করেছে। ক্যাসেটের মেয়েটাও হাসছে।
জাহানারার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। পানি কেন আসছে কে জানে? চোখে পানি আসার মত কোনো ঘটনাতো ঘটেনি। তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের এক কোণায় কালো পর্দায় ঢাকা ময়নার খাঁচা। লোকজনের কথাবার্তায় বেচারার ঘুম ভেঙে গেল। সে কয়েকবার ডানা ঝাণ্টাল। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল,
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
মোতাহার সাহেব এতক্ষণ কাত হয় ছিলেন, এখন চিৎ হলেন। এই সামান্য কাজটা করতে গিয়ে তাঁর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কপালে ঘাম জমল। এর মানে কী? তিনি কি মারা যাচ্ছেন? দরজার বাইরে কি আজরাইল এসে দাঁড়িয়েছে? আজরাইলের চেহারা দেখতে কেমন? সবার ধারণা তার চেহারা হবে কুৎসতি। কিন্তু তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজরাইল হবে সুপুরুষ যুবা। আজরাইল হচ্ছে ফেরেশতা। তাঁকে আল্লাহ কেন কুৎসিত করে বানাবেন?
কোমরের কাছে ব্যথার মত হচ্ছিল। সুচ ফুটানোর মত ব্যথা। ব্যথাটা দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। হাত-পা অসাড় হয় গেল। যেন কয়েকজন মিলে একটা শীতল ভারী পাথর পায়ের উপর দিয়ে দিয়েছে। এই পাথর নাড়ানোর সাধ্য তার নেই। মৃত্যু কি এ রকম? শরীরে পাথর বসানো দিয়ে এর শুরু? প্রচণ্ড ভারী একটা পাথর পায়ের উপর নিয়েই তিনি কাত অবস্থা থেকে চিৎ হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় পাথরটা গড়িয়ে পড়ে যাবার কথা। তা পড়ে নি। বরং পাথরটা আরো ভালমত বসেছে। তাঁর মন বলছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা ভারী পাথর তাঁর বুকের উপর দিয়ে দেয়া হবে। তিনি বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন। বুকের উপর ভারী পাথরের কারণে তা পারবেন না। তিনি যতই নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন পাথর ততই চেপে বসবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর মৃত্যু হবার কথা না। ভাই পাগলা পীর তাকে স্পষ্ট করে বলেছে— তোর মৃত্যু একসিডেনে। একসিডেন মানে এক্সিডেন্ট। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রকম এক্সিডেন্ট? রোড এক্সিডেন্ট না অন্য কিছু? ভাই পাগলা পীর মিচিকি মিচিকি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অন্য কিছু। অনেক রক্ত বাইর হইব বুঝছস। রুক্তের মইধ্যে তুই সিনান করবি। মোতাহার সাহেব চিন্তিত এবং ভীত গলায় বলেছিলেন, হুজ্বর আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। ভাই পাগলা পীর পিচ করে একদলী থুথু ফেলে বললেন, দূর ব্যাটা আমি দেয়া করি না। আর দোয়া কইরা কোনো ফয়দা নাই। আল্লাহপাক তাঁর চিকন কলম দিয়া তোর কপালে যা লেখছেন। তাই হইব। তোর কপালে যদি লেখা থাকে মিত্যুর আগে গরম রক্ত দিয়া সিনান, তাইলে তাই হইব। দোয়া না করলেও হইব। করলেও হইব। খামাখা সময় নষ্ট কইরা ফয়দা কী?
ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। তিনি মারা যাচ্ছেন। কাজেই তিনি পীর সাহেবকে গিয়ে বলতে পারবেন না— হুজ্বর আপনের কথা সত্য হয় নাই। আমার মৃত্যু হয়েছে বিছানায়। সবাই বলে ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা কখনো মিথ্যা হয় না। এইবার কেন হচ্ছে?
তাঁর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। তিনি এই তৃষ্ণাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন। মৃত্যুর আগে আগে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার মত হয়, কিন্তু তখন পানি খাওয়া যায় না। পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, পানি তিতা লাগে।
মোতাহার সাহেব তাঁর স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। একজন ডাক্তার ডাকা দরকার। হাসপাতালে তাকে নেবার প্রয়োজন হতে পারে। ড্রাইভার কি আছে? এই ড্রাইভারের চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। রাতে তার একতলায় কোণার ঘরষ্টীয় শুয়ে ঘুমানোর কথা। তিনি খবর পেয়েছেন প্রায়ই সে তা করে না। বাইরে রাত কাটিয়ে ফজরের নামাজের সময় উপস্থিত হয়। আজও হয়ত সে নেই।
হাসপাতালে তিনি যেতে চান না। তাঁদের পরিবারের একটা ধারা আছে। এই পরিবারের মানুষ যদি হাসপাতালে যায় তাহলে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে না। মোতাহার সাহেবের বাবা ফিরেন নি। তাঁর বড় ভাই ফিরেন নি।
কাজেই হাসপাতালে যদি যেতেই হয় কিছু জরুরি কথা ফিসফিস করে হলেও বলে যেতে হবে। শুভ্ৰকে একটা কথা বলা দরকার। শুভ্ৰ যেন তার উপর রাগ না। করে। তাকে ঘৃণা না করে। সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পুত্র এবং কন্যার ঘৃণা সহ্য করা যায় না। যে ব্যক্তিকে তাহার পুত্র এবং কন্যা ঘৃণা করে দোজখের অগ্নিও তাহাকে ঘৃণা করে। কথাটা কে বলেছে? কার কাছ থেকে শুনেছেন? ভাই পাগলা পীর সাহেবের কাছ থেকে?