রহমত মিয়া বলল, আপনে ঘরে যান, আমি পান দিয়া আসব।
রহমত মিয়া তীব্ৰ চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। পশুদের চোখের জ্বলজ্বলে ভাব একসময় নাইটগার্ডদের চোখেও চলে আসে। পশুদের সঙ্গে কোথাও বোধহয় তাদের মিল আছে।
খিলখিল করে কে যেন হাসছে
খিলখিল করে কে যেন হাসছে।
জাহানারা একতলা থেকে দোতলায় উঠছিলেন— তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হাসির শব্দ শুভ্ৰর ঘর থেকে আসছে। শুভ্ৰর ঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার ওপাশে তরুণী কোনো মেয়ে হেসে ভেঙ্গে পড়ছে। এর মানে কী? জাহানারার হাত পা, ঠাণ্ডা হয়ে এল। এখনো তিনি দোতলায় পুরোপুরি উঠেন নি। চারটা ধাপ বাকি আছে। মনে হচ্ছে এই চারটা ধাপ আর উঠতে পারবেন না। শেষধাপে পা দেবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তিনি বুকে একটা চাপ ব্যথা অনুভব করলেন।
বিনু মেয়েটা কি গিয়েছে শুভ্রর ঘরে! রাত একটার সময় এই মেয়ে তার ছেলের ঘরে কেন থাকবে? আর মেয়ের এত সাহস সে খিলখিল করে হাসবে?
জাহানারা শুভ্রর বন্ধ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। হয়ত দরজা বন্ধ না, হয়ত দরজা ভেজানো। জাহানারা দরজার গায়ে হাত রাখলেন। দরজার পাল্লা খানিকটা ভেতরের দিকে সৱে গেল। এইত শুভ্ৰকে দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে বসে আছে। পা তুলে দিয়েছে বিছানায়। তার হাতে বই। টেবিল ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে তার গায়ে। শুভ্ৰ পরেছে সাদার উপর ফুলতোলা শার্টটা। এই শার্টটা তাকে খুব মানায়। শার্টটায় ইস্ত্রি নেই। তাঁর লক্ষ করা উচিত ছিল।
ঘরে কোনো মেয়ে নেই। ঘরে আর কেউ থাকলে শুভ্ৰ নিশ্চয়ই এত মন দিয়ে বই পড়ত না। জাহানারা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন। হয়ত বিনু মেয়েটা তার ঘরে হাসছে। বাতাসে সেই হাসি এমনভাবে ভেসে এসেছে যে মনে হয়েছে হারামজাদি মেয়ে শুভ্রর ঘরে। জাহানারা দরজাটা আরেকটু ফাঁক করলেন। দরজায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হল— শুত্র দরজার দিকে তাকল না।
শুভ্ৰ!
শুভ্র বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ভেতরে এসো মা।
তুই এখনো ঘুমুস নি?
উঁহু।
জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। ফাঁকা ঘর। তিনি লজ্জিত বোধ করলেন। ঘরতো ফাঁকাই থাকবে। তিনি কি ভেবেছিলেন কেউ একজন ঘরে বসে থাকবে? ছিঃ ছিঃ। শুভ্ৰ কি এমন ছেলে? সে তার নামের মতই শুভ্ৰ।
এত মন দিয়ে কী বই পড়ছিস?
প্রাচীন কথামালা।
সেটা আবার কী?
প্রবচন। উদাহারণ দিলে বুঝবে- একটা আরবি প্রবচন হল, If you meet a blind man, kick him. Why should you be kinder than God?
বুঝতে পারলাম না।
মনে কর তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। হঠাৎ একটা অন্ধ লোক দেখলে। তখন তোমার উচিত তাকে একটা লাথি মারা।
কেন?
কারণ আল্লাহর চেয়ে বেশি দয়ালু হবার তোমার দরকার কী?
এখনোতো কিছু বুঝলাম না।
থাক বুঝতে হবে না। এটা শুধু মনে রাখলেই চলবে— আমি যখন অন্ধ হয়ে যাব তখন আমাকে দেখলেই হয় লাথি দেবে নয়। চড় বসাবে।
এই সব কী ধরনের কথা? তুই অন্ধ হবি কোন দুঃখে। আর তোকে আমি খামাখা চড় লাথিই বা মারব কেন?
শুভ্ৰ মিটমিট করে হাসছে। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়! জাহানারা ছেলের সামনে বসলেন। শুভ্ৰ সঙ্গে সঙ্গে পা নামিয়ে নিল। জাহানারা বললেন- আমি একতলা থেকে দোতলায় উঠছি হঠাৎ মনে হল তোর ঘর থেকে হাসির শব্দ আসছে। মনে হল একটা মেয়ে যেন খিলখিল করে হসছে।
তোমার বুকে একটা ধাক্কার মত লাগল। তাই না মা?
ধাক্কার মত লাগবে কেন?
রাত একটিার সময় তোমার ছেলের ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে, তোমারতো মা হার্ট এ্যাটাক হবার কথা।
আমার সম্পর্কে তোর ধারণাটা কী বলতে শুভ্ৰ?
তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা হচ্ছে তুমি খুবই সন্দেহপ্রবণ একজন মহিলা। তবে সরল টাইপ। তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ হয়। সেই সন্দেহ লুকিয়ে রাখার কায়দা কানুনও তোমার জানা নেই! তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে কর। তুমি কিন্তু তা না। বোকা টাইপ মাদার।
জাহানারা চুপ করে রইলেন। তাঁর খুবই অবাক লাগছে। ছেলে কত অবলীলায় তার মা সম্পর্কে কঠিন কঠিন কথা বলছে। শুভ্ৰ কি বদলে যাচ্ছে? বদলে যাবার পেছনে বিনু মেয়েটার হাত নেই তো? একজন খারাপ মানুষ অতি দ্রুত একজন ভালমানুষকে খারাপ বানিয়ে ফেলতে পারে।
মা তুমি রাগ করেছ?
না।
আমার ঘর থেকে যে হাসির শব্দ শুনলে সেই হাসি কেমন ছিল? মিষ্টি ছিল?
জানি না।
আরেকবায় শুনে দেখতো মা। মন দিয়ে শুনে আমাকে বলবে হাসিটা কেমন। রেডি, গেট সেট, ওয়ান-টু-থ্রি গো।
জাহানারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র তার পাশে রাখা ক্যাসেট প্লেয়ার কোলে তুলে নিল। বোতাম টেপা মাত্র খিলখিল হাসি শোনা গেল। শুভ্র বলল, ময়নাটাকে শেখানোর জন্যে হাসি রেকর্ড করে রেখেছি। ময়নার খাচার পাশে এই ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দেব। ময়না অসংখ্যবার এই হাসি শুনবে। তারপর একদিন দেখা যাবে সে হাসতে শিখে গেছে। হাসিটা কেমন মা?
ভাল।
তোমার মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে করে ফেল।
কী প্রশ্ন?
অনেকগুলি প্রশ্নইতো তোমার মনে এসেছে। যেমন- রেকর্ড করা হাসিটা কোন মেয়ের? তার পরিচয় কী? বয়স কত? মেয়েটার বাবা কী করেন? বাড়ির অবস্থা কী? ইত্যাদি ইত্যাদি।
জাহানারা দুঃখিত গলায় বললেন, তুই আমাকে দেখতে পারিস না তাই না?
দেখতে পারব না কেন? আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম।
জাহানারা নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবার শরীরটা আজ আবার খারাপ করছে।