মীরা বলল, আখলাক সাহেবের সঙ্গে কী নিয়ে গল্প হচ্ছিল?
শুভ্ৰ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আখলাক সাহেব বললেন, বাংলাদেশের সবচে বড় পতিতালয়টি শুভ্ৰদের বাড়ির ঠিক পেছনে। এক সময় ঐ অঞ্চলে আমার সামান্য যাতায়াত ছিল। এই নিয়েই আমরা কথা বলছিলাম। তোমার বন্ধু অবশ্যি আমার কথায় একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছে।
শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন বাসায় যাব।
মীরা বলল, গান শুনবি না?
না।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তুই কি সঙ্গে গাড়ি এনেছিস? না-কি তোকে গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে?
শুভ্রর বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল। গাড়ির কথাতে মনে পড়েছে সে গাড়ি আনে নি। রিকশা করে এসেছে। সেই রিকশা ভাড়া দেয়া হয় নি। রিকশাওয়ালা হয়ত এখনো অপেক্ষা করছে।
আখলাক সাহেব বললেন, শুভ্ৰ, ইজ এনিথিং রং? হঠাৎ করে আপনার মুখের ভাব বদলে গেল। এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি।
শুভ্র বলল, আমি রিকশা ভাড়া দেই নি। টাকা ছিল না, ভেবেছিলাম মীরার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দেব। ভুলে গেছি। এখন খুবই লজ্জা লাগছে।
এটা এমন কোনো ভয়ংকর অপরাধ না যে মুখ শুকিয়ে ফেলতে হবে। রিকশাওয়ালা যদি অপেক্ষা করে থাকে তাহলে সে তার ওয়েটিং চার্জ পাবে। আর যদি ভাড়া না নিয়ে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে সে বোকা। বোকারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। কাজেই আপসেট হবার কিছু নেই।
আখলাক সাহেব পা নাচাতে নাচাতে বললেন, শুভ্ৰ, আপনার সঙ্গে একহাজার টাকা বাজি— আপনি বারান্দায় গিয়ে দেখবেন, রিকশাওয়ালা আপনার জন্যে অপেক্ষা করে নেই। চলে গেছে। রাখবেন বাজি?
শুভ্ৰ কথার জবাব না দিয়ে বাইরের বারান্দায় চলে এল। বারান্দা থেকে গেট দেখা যাচ্ছে। গেটের পাশে কোনো রিকশাওয়ালা নেই।
বসার ঘরে গান শুরু হয়ে গেছে। বিরক্ত মুখের গায়ক এখন হাস্যমুখী হয়ে কীর্তন গাইছেন। ভদ্রলোকের গলা অবিকল মেয়েদের মত। শ্যাম ছাড়া আমি বাঁচিব কেমনে। এই আকুলতা তাঁর গলায় খুব মানিয়ে গেছে। তাঁর গলা একটু পুরুষালী হলে গানটা এত ভাল লাগত না।
আখলাক সাহেব বারান্দায় চলে এসেছেন। তার হাতে এখনো সেই পানির প্লাস। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্ৰকে দেখছেন।
শুভ্র বলল, কিছু বলবেন?
না, কিছু বলব না। রিকশাওয়ালা চলে গেছে?
জ্বি।
বাজি ধরলে হেরে যেতেন। বাজি না ধরে ভাল করেছেন।
আপনি কি সব কিছু নিয়েই বাজি ধরেন?
হ্যাঁ, ধরি। শুনুন শুভ্ৰ, আপনাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। রাগ করবেন কি-না এটা ভেবে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে।
রাগ করব না। জিজ্ঞেস করুন।
ঢাকা শহরের সবচে বড় পতিতালয়ের সঙ্গেই আপনাদের বাড়ি। আপনার কি কখনো সেখানে যেতে ইচ্ছা করে নি?
না, আমার কখনো যেতে ইচ্ছা করে নি।
আখলাক সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আপনার কথার ধরন থেকেই বুঝতে পারছি আপনি সত্যি কথা বলছেন। আপনি সত্যবাদী মানুষ এটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমার এক প্রাইভেট টিচার ছিলেন— যামিনি বাবু। উনি বলতেন— সত্যবাদী মানুষ কখনো খারাপ হতে পারে না। ছোটবেলায় স্যারের কথাটাকে ধ্রুব সত্য বলে মনে হত। এখন জানি কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা। আমি খুবই সত্যবাদী। একটাও মিথ্যা বলি না। কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ মানুষ এই শহরে খুব নেই।
শুভ্র বলল, আমি আজ যাই। অন্য আরেক দিন আপনার সঙ্গে কথা হবে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। শুভ্ৰ পথে নেমে গেল।
শুভ্ৰদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা কিছুদূর গিয়েই নাম নিয়েছে ইংলিশ রোড। অন্যটা গিয়েছে সরাসরি পতিতালয়ের দিকে। এই রাস্তাটা ভাঙ্গা। খানাখন্দে ভরা। মিউনিসিপালটি এইসব অঞ্চলের রাস্তাঘাট নিয়ে মাথা ঘামায় না। লাইটপোষ্টের কোনোটিতে বাতি নেই। বাতি না থাকার জন্যে কোনো অসুবিধা অবশ্যি হয় না। রাস্তার দুপাশে পান সিগারেটের দোকানে বাতি জ্বলে। দোকানগুলি সারারাতই খেলো থাকে।
আকাশে মেঘ জমছে। দু এক ফোটা বৃষ্টিও পড়ছে। শুভ্রর হাতে এক ফোটা পড়ল। সে মাথা উঁচু করে আকাশ দেখল। আকাশের কোন জায়গাটা থেকে বৃষ্টি পড়ছে এটাই বোধহয় দেখার ইচ্ছা। শুভ্ৰ তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নিশিপল্লীতে লোকজন যাওয়া শুরু করেছে। এদের দিকে তাকানোর ইচচ্ছা! শুভ্রর কখনো মনে হয় নি। আজ সে দেখছে। এর কারণ কী আখলাক সাহেব? এরা যেভাবে যাচ্ছে আখলাক সাহেব কি সে ভাবেই যেতেন? বেশির ভাগ মানুষের চোখে মুখে কোনো আনন্দ নেই। যা আছে তার নাম ভীতি। গরমের মধ্যেও অনেকের গায়ে চান্দর। চাঁদর মাথার ওপর তুলে দেয়ায় মুখ ঢাকা পড়েছে। কেউ কেউ রাতেই সানগ্লাস পরেছে। মানুষ হাঁটার সময় দুপাশে তাকায়। না ডাকলে কখনো পেছনের দিকে তাকায় না। এরা এই রাস্তায় যখন হাঁটে— কিছুক্ষণ পর পর এমন ভঙ্গিতে পেছনের দিকে তাকায় যেন কেউ পেছন থেকে তাদের ডাকছে।
ছোট বাবু!
শুভ্ৰ চমকে উঠল। বাড়ির নাইটগার্ড রহমত মিয়া ঠিক তার কানের কাছে এসে ছোটবাবু বলেছ।
এইখানে দাঁড়াইয়া আছেন কেন?
দেখি।
কী দেখেন?
লোকজন যে যাচ্ছে সবাইকে দেখছি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন কিনছে। কী কিনছে?
পান।
সবাই এক দোকান থেকে পান কিনছে কেন?
এইটা হইল হাফিজের দোকান! হাফিজের দোকানের পান খুবই বিখ্যাত।
শুভ্ৰ বলল, রহমত মিয়া তুমি একটা কাজ করত। হাফিজের দোকানের একটা পান। কিনে আন। হাফিজের দোকানোর পান খেতে ইচ্ছা করছে।