ধর দু মিনিট।
দু মিনিট ধরে হাসা অসম্ভব ব্যাপার। আমার এত দম নেই। এক মিনিটে হবে?
হবে।
হাসির রেকর্ডটা কি এখনই দরকার?
পরে হলেও হবে।
পরে কেন, এসেছিস যখন আজই নিয়ে যা। ঝামেলা শেষ হয়ে যাক। একটু অপেক্ষা কর।
আচ্ছা।
এক কাজ কর। পার্টিতে খুব ইন্টারেস্টিং একজন ভদ্রলোক আছেন। নাম আখলাক। তোর উল্টো পিঠ। তুই তার সঙ্গে গল্প কর। আমি হাসি রেকর্ড করে নিয়ে আসি।
শুভ্র বলল, আমার উল্টো পিঠ মানে কী?
তুই পূর্ব হলে সে পশ্চিম। তুই সুমেরু হলে সে কুমেরু। খুবই মন্দ টাইপ মানুষ।
আমি কি ভাল টাইপ?
হুঁ।
মীরা আখলাক সাহেবকে খুঁজছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে শুভ্ৰ। শুভ্ৰ ভেবে বের করার চেষ্টা করছে— মীরা অন্য মেয়েদের থেকে কি একটু আলাদা? না-কি সে আলাদা হবার ভাব করে? অন্য যে-কোনো মেয়ে জানতে চাইত হাসির রেকর্ড দিয়ে কী হবে। মীরা জানতে চাইছে না। তার কি আসলেই জানতে ইচ্ছে করছে। না? না-কি সে মনের ইচ্ছেটা চাপা দিয়ে রেখেছে?
আখলাক সাহেব বসার ঘরের এক কোণায় একা একা বসে আছেন। তার হাতে এক গ্লাস পানি। তিনি পানিতে খুব ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছেন। যেন তিনি পানি খাচ্ছেন না, হুইস্কি খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের চেহারা সাধারণ। পোশাক পরিচ্ছদও সাধারণ। ছাই রঙের ইস্ত্রি বিহীন হাফ সার্টের সঙ্গে লাল টাই। ছাই রঙের সার্টের কারণে লাল টাইটা খুব ফুটেছে। চশমা পরেছেন। চশমা নাকের ডগার কাছাকাছি চলে এসেছে। তিনি তাকাচ্ছেন চশমার ফাঁক দিয়ে। শুভ্ৰ ছোটবেলায় একটা বই পড়েছিল, নাম শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা। এই বই-এর প্রচ্ছদে চশমা চোখে এক শিয়ালের ছবি ছিল। ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে শিয়ালের মত।
মীরাকে দেখে তিনি নিচু গলায় বললেন, তোমাদের গান শুরু হতে কত দেরি?
মীরা বলল, জানি না। আপনি একটু শুভ্ৰকে কোম্পানি দিনতো। ও খুব বোর ফিল করছে। বলেই মীরা প্রায় উড়ে চলে গেল।
আখলাক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। শুভ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, আমার নাম আখলাক। পেশায় আমি একজন আর্কিটেক্ট। সবার কাছে দুষ্টলোক হিসেবে পরিচিত। ফেরেশতাদের কোম্প্যানি ইন্টারেস্টিং হয় না, দুষ্টলোকদের কোম্প্যানি ইন্টারেস্টিং হয়। বসুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
শুভ্র বসল। বয়স্ক একজন মানুষ তাকে আপনি আপনি করছেন, সম্মানের সঙ্গে কথা বলছেন, পরিচয় করিয়ে দেবার সময় উঠে দাঁড়ালেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটু যেন অস্বস্তিকর।
শুত্র সাহেব!
জ্বি।
শুভ্ৰ নামের শেষে সাহেব ব্যবহার করছি আপনার অস্বস্তি লাগছে না?
জ্বি লাগছে।
লাগাই উচিত। আমার ধারণা শুভ্র সাহেব বলে এর আগে কেউ আপনাকে ডাকে নি। আমি কি ঠিক বলেছি?
জ্বি।
মীরা আপনার সঙ্গে পড়ে?
জ্বি।
আপনাকে কি সে খুব পছন্দ করে?
আমি জানি না।
আপনারীতে জানা উচিত। কেন জানেন না? একটা মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দেয়া যায়। সে আপনাকে পছন্দ করছে বা করছে না। সে আপনার সঙ্গ কামনা করছে না-কি করছে না।
আপনি পারেন?
অবশ্যই পারি। এই কাজটা দুষ্টলোকরা শুধু যে ভাল পারে তা-না, খুব ভাল পারে। কেন পারে জানেন?
জ্বি না।
কারণ দুষ্টলোকদের মেয়েদের চোখের ভাষা পড়তে শেখাটা খুব জরুরি। তাকে মেয়েদের চোখের ভাষা পড়ে ভবিষ্যৎ কর্ম পদ্ধতি ঠিক করতে হয়।
ও আচ্ছা।
মীরা যখন আপনাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল তখন দেখলাম মমতা এবং ভালবাসায় তার চোখ টনটন করছে। কাজেই আমার ধারণা সে আপনাকে খুবই পছন্দ করে।
শুভ্র সহজ গলায় বলল, আপনি কি পুরুষদের চোখের ভাষা পড়তে পারেন?
আখলাক সাহেব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, না। পুরুষদের চোখে কোনো ভাষা থাকে না। কাজেই পুরুষের চোখের ভাষা পড়া অসম্ভব। শুভ্র সাহেব?
জ্বি।
ধূমপান করেন?
জ্বি না।
ভাল করে মনে করে দেখুন। কোনো বিয়ের দাওয়াতে গেছেন, খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব কাশছেন। এমন কখনো হয় নি?
জ্বি না, হয় নি।
মদ্যপান করেছেন?
জ্বি-না।
আখলাক সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমার প্রশ্ন শুনে অস্বস্তি বোধ করছেন?
জ্বি-না।
আমার প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে। এখন আপনি যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, জিজ্ঞেস করতে পারেন। আপনার অবগতির জন্যে বলছি অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব দিতেই আমি সবচে স্বস্তি বোধ করি।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না।
আপনার বাসা কোথায়?
ইংলিশ রোডে।
ইংলিশ রোডের কোথায়? ঐ অঞ্চলটা আমার খুব ভাল করে চেনা। চিত্রমহল সিনেমা হলের কোন দিকে?
পশ্চিম দিকে।
গোলাপপাল রোডের আগে?
গোলাপপাল রোডে। দশের এক গোলাপপাল রোড।
আখলাক সাহেব একটু ঝুঁকে এসে আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনাদের কাছেই বড় একটা পতিতালয় আছে না?
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। আখলাক সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আপনার বাড়ির পাশে পতিতালয়, সেই দোষতো আপনার না। আপনিতো আর পতিতালয় দেন নি। কিংবা ইচ্ছা করে পতিতালয়ের পাশে বাড়ি ভাড়া নেন নি।
মীরা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসেছে। শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। মীরা বলল, এখন ইচ্ছা করলেও যেতে পারবি না। গান শুরু হচ্ছে। টেবিলে খাবার লাগানো হয়েছে। খেতে খেতে গান শোন। না-কি খুব বেশি বোর ফিল করছিস?
আমার গান শুনতে ইচ্ছা করছে না।
তোর একার না। এখানে কারোরই গান শুনতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু দেখবি গান শুরু হলেই সবাই এমন ভাব করবে যেন স্বৰ্গ সুখ অনুভব করছে।