শুভ্ৰ বলল, মন খারাপ করে থাকেন কেন?
মীরা হাসি মুখে বলল, বিবাহ বার্ষিকী আসলে দুজনের উৎসব। বাবাকে সেই উৎসব একা একা পালন করতে হয়।
শুভ্ৰ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। মীরা বলল, জিজ্ঞেস কর, কেন বাবাকে এক এক উৎসব পালন করতে হয়।
কেন?
কারণ আমার মা তাঁর তিন নম্বর কন্যার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। বাবা তখন পত্নীপ্ৰেমে শরৎচন্দ্রের নায়কের মত হয়ে যান। বিরাট একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেন— বাকি জীবন বিবাহ করব না। বুকে স্ত্রীর স্মৃতি রেখে কন্যাদের বড় করব।
ও।
বাবার ক্যারেক্টাটার তোর কি ইন্টাররেটিং মনে হচ্ছে?
হুঁ।
বাবার চরিত্রের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কোনো ব্যাপারই নেই। বাবা খুবই বোরিং টাইপের মানুষ। এক অর্থে মা ভাগ্যবতী, দীর্ঘদিন একজন বিরক্তিকর স্বামীর সঙ্গে থাকতে হল না। চল যাই বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। জাষ্টি হ্যালো বলে। বাবার কাছ থেকে ছুটে আসবি। বাবা কিন্তু তোকে আটকে ফেলার চেষ্টা করবে। আটকা পড়ে গেলে তোর নিজেরই ক্ষতি। বাবা পাঁচশর মত বোরিং গল্প জানে। সে চেষ্টা করবে। সবই তোকে শুনিয়ে ফেলতে; আগে ভাগে বলে দিলাম। যাতে পরে আমাকে দোষ দিতে না পারিস।
মীরার বাবা ব্যারিস্টার ইয়াসিন তাঁর শোবার ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। মানুষটা অত্যন্ত সুপুরুষ। মাথায় সব চুল পেকে ধবধবে সাদা। সাদা চুলের যে আলাদা সৌন্দৰ্য আছে তা ইয়াসিন সাহেবকে না দেখলে কেউ তেমন জোরের সঙ্গে বলতে পারবে না। তিনি পারছেন। ধবধবে সাদা রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি! মনে হচ্ছে এই পোষাকেই তাকে সবচে মানায়; তবে শুভ্রর ধারণা, এই মানুষটা যে পোষাকই পরবে মনে হবে সেই পোষাকে তাকে সবচে ভাল মানায়।
ইয়াসিন সাহেবের গায়ের রঙ বিদেশীদের মত লালচে ধরনের সাদা। স্বাস্থ্যু ভাল। তাঁকে দেখে মনে হয়। তিনি আসলে একজন যুবা পুরুষ। কোন এক সিনেমায় বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। মেকাপ ম্যান ভাল মেকআপ দিতে পারে নি বলে চেহারায় যুবা ভাব রয়ে গেছে।
মীরা বলল, বাবা একজনকে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এনেছি। তাকে ভাল করে দেখে বল দেখি সে কে?
ইয়াসিন সাহেব বালিশের উপর রাখা চশমা চোখে দিয়ে পরীক্ষকের ভঙ্গিতে শুভ্রর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এর নাম শুভ্র। হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে। কী করে বললে?
চশমা দেখে বললাম, তুই বলেছিলি শুভ্র খুব ভারী কাচের চশমা পরে। শুভ্ৰ! বাবা তুমি বোস। চেয়ারটা টেনে বোস।
শুভ্ৰ কিছু বলার আগেই মীরা বলল, শুভ্র বসবে না। বাবা। ও চলে যাবে।
চলে যাবে কেন?
শুভ্ৰকে আসলে দাওয়াত করা হয় নি। ও নিজে নিজে কী মনে করে যেন চলে এসেছে। এখন অপরিচিত সব লোকজন দেখে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। তাই না শুভ্র? তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না?
শুভ্ৰ হাসল, কিছু বলল না। ইয়াসিন সাহেব বললেন, অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে কথা না বললে পরিচিত হবে কীভাবে? তাছাড়া আমিতো আর এখন অপরিচিত না; ও আমার সঙ্গে গল্প করুক। তুই যা আমাদের জন্যে চট করে। দুকাপ চা পাঠিয়ে দে।
তোমার ম্যারেজ এ্যনিভার্সিরি উপলক্ষে লোকজন এসেছে আর তুমি মুখ ভোতা করে শোবার ঘরে বসে আছ এটা কেমন কথা। তুমি দয়া করে বসার ঘরে যাও। এক্ষুণি গান শুরু হবে। আর শুভ্র এখানে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসে। নি। বোরিং গল্প সে সহ্যই করতে পারে না। তাছাড়া শুভ্র কখনো কোনো কাজ ছাড়া কোথাও যায় না। এখানে যে এসেছে। কোনো একটা কাজে এসেছে বলে আমার ধারণা। শুভ্ৰ বল দেখি কী জন্যে তুই এসেছিস?
শুভ্র একটু হকচাকিয়ে গেল। মীরা বলল, বাবার সামনে বলতে লজ্জা লাগলে আয় বারান্দায় চলে আয়। বাবা শোন, তুমি দয়া করে বসার ঘরে গিয়ে বোস, আমি শুভ্রর কথা শুনে তাকে বিদায় করে তারপর আসছি।
বসার ঘরের মত বাক্সান্দাতেও অনেক লোকজন। বেশির ভাগই মেয়ে। ফিল্যের নামকরা এক নায়িকা এসেছেন। বারান্দায় জটলােটা তাকে ঘিরে। নায়িকারা অনেক লোকজনের মাঝখানে সহজে মুখ খুলেন না। ইনি সে রকম না। বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প করছেন। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার গল্প বলছেন। সবাই আগ্ৰহ নিয়ে শুনছে। একবার তিনি মোস্তফার দোকানে শপিং করতে গিয়েছেন। হঠাৎ সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাঙালিরা তাকে চিনে ফেলে ঘিরে ধরল। দোকানের লোকজন ভাবল— অন্য কিছু। তারা পুলিশে খবর দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে বাঙালির সংখ্যা আরো বাড়ছে। ম্যাডাম হঠাৎ ভয়ে এবং দুঃশ্চিন্তায় ফেইন্ট হয়ে মেঝোয় পড়ে গেলেন। সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে তাকে নিয়ে গেল এলিজাবেথ হাসপাতালে। এলিজাবেথ হাসপাতাল হচ্ছে সিঙ্গাপুরের সবচে বড় হাসপাতাল। সব আমেরিকান ডাক্তার। কাজেই এক অর্থে আমেরিকান হাসপাতাল। দীর্ঘ ক্লান্তিকর গল্প। কিন্তু সবাই শুনছে খুব আগ্রহ নিয়ে।
মীরা শুভ্রকে বারান্দার এক কোণায় নিয়ে গিয়ে বলল, এখন বল আমার কাছে এসেছিস কী জন্যে? সৌজন্য সাক্ষাৎ? না-কি অন্য কিছু? আমার প্রেমে তুই হাবুডাবু খাচ্ছিস এ ধরনের সস্তা ডায়ালগ দিবি নাতো?
শুভ্র ইতস্তত করে বলল, তোমাদের বাসায় কি ক্যাসেট রেকর্ডার আছে?
মীরা বলল, আছে। অডিও ভিডিও সবধরনের রেকর্ডার আছে। কোনটা দরকার।
একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেটে তুমি কি তোমার হাসি রেকর্ড করে আমাকে দিতে পার?
অবশ্যই পারি। কেন পারব না! কতক্ষণের হাসি? এক মিনিট, দুমিনিট না টানা তিন মিনিট।