বাড়ির গেটে পুলিশের পোশাক পরা দারোয়ান। দারোয়ানের পাশেই শিকল দিয়ে বাধা মস্ত বড় কুকুর; কুকুরটার শরীর মস্ত বড় হলেও তার চোখ গরুর চোখের মত শান্ত। বাড়ির সামনে শুধু যে বাগান আছে তাই না, ছোট্ট একটা ফোয়ারাও আছে। ফোয়ারার মাঝখানে পাথরের পরীমূর্তি। পরীর একটা ডানা ভাঙ্গা। ডানা ভাঙ্গা হলেও কী যে অপূর্ব সেই মূর্তি মূর্তির পা থেকে বিরঝির করে পানি বের হচ্ছে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্ৰয় মনে হল- এই বাড়ি মানুষ থাকার জন্যে বানানো হয় নি- ছবির শুটিং এর জন্যে বানানো। তাও সব ধরনের ছবি না। রূপকথা জাতীয় ছবি। হেনসেল এন্ড গ্রেটেলের রূপকথা। দারোয়ান বলল, কাকে চান? দারোয়ানের চোখও কুকুরটার চোখের মত শান্ত। ধমক দেয়া দারোয়ান না। ধমক দেয়া দারোয়ান বা ভয়ংকর চোখের কুকুর এ বাড়িতে মানাতো না।
শুভ্ৰ পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে বলল, এটা কি মীরাদের বাড়ি? ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এপ্লায়েড ফিজিক্স।
দারোয়ান বলল, জ্বি। যান। ভেতরে যান।
শুভ্র বলল, আমি রিকশা করে এসেছি কিন্তু রিকশা ভাড়া দিতে পারছি না। মানিব্যাগ ফেলে এসেছি। মীরার কাছ থেকে রিকশা ভাড়া আনতে হবে।
দারোয়ানকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। শুভ্ৰ কেন বলছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কোনো কোনো মানুষ আছে যাদের দেখলেই বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে। মীরদের বাড়ির দারোয়ান মনে হয়। সেই গোত্রের। শুভ্র বলল, এই কুকুরটা কি এলশেশিয়ান?
জ্বি না। এটা জার্মান ডোভার।
আমি এক্ষুণি রিকশা ভাড়া নিয়ে ফিরে আসছি। আপনি যদি দেখেন রিকশাআলা অস্থির হয়ে গেছে তাকে শান্ত করবেন। পারবেন না?
দারোয়ান মাথা নাড়ল। শুভ্ৰ লন পার হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। শুভ্ৰর মনে হচ্ছে জার্মান ডোভার নামের ভয়ংকর কুকুরটা তার পেছনে পেছনে আসছে। যদিও সে পরিষ্কার দেখেছে কুকুরটা শিকল দিয়ে বাধা। এইটুক পথ পার হতে শুভ্র কয়েকবার পেছনে তাকাল। প্রতিবারই দেখল কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে, এবং রিকশাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকশাওয়ালা তার বিষয়ে কী ভাবছে তা সে অনুমান করতে পারছে, কিন্তু দারোয়ান এবং কুকুরটা তার বিষয়ে কী ভাবছে কে জানে!
মীরাদের বাড়িতে আজ কোনো একটা উৎসব। হলঘরের মত বিরাট বসার ঘরে মানুষ গিজগিজ করছে। সবার গায়ে উৎসবের পোশাক। মনে হচ্ছে রঙের মেলা বসেছে। শুভ্ৰর মনে প্রথম যে চিন্তাটা এল তা হচ্ছে। এত অতিথি নিশ্চয়ই হোটে হেঁটে আসে নি, গাড়ি করে এসেছে। গাড়িগুলি কোথায় রাখা হয়েছে? বাড়ির সামনেতো একটা গাড়িও ছিল না। বাড়ির সামনে শুধু তার রিকশাটিা অপেক্ষা করছে। রিকশাওয়ালীকে পনেরো টাকা ভাড়া দিতে হবে। ভাংতি পনেরো টাকা কি মীরার কাছে আছে! এত বড় বাড়িতে যারা থাকে তাদের কাছে ভাংতি টাকা থাকার কথা না। তবে না থাকলেও সে জোগাড় করে দেবে। অবশ্যি মীরার যা স্বভাব সে হয়ত বলে ফেলতে পারে, যা ভাগ, আমি তোকে টাকা দেব কেন?
শুভ্র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে সে যখন লন পার হচ্ছিল তখন তিনজন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দুজন মানুষ আর একটা কুকুর। আর এখন হল ভর্তি মানুষ অথচ কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত। সবাই কথা বলছে। ঘরের একেবারে শেষ মাথায় ষ্টেজ তৈরি করা হয়েছে। বোধহয় গান বাজনা হবে। স্টেজের ঠিক মাঝখানে বিরক্ত মুখে মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিই গায়ক। এবং বেশ নামি গায়ক। নামি গায়করা গান শুরু হবার আগ পর্যন্ত খুব বিরক্ত হয়ে থাকেন। শুধুমাত্র গান করার সময় হাসিমুখে গান করেন। গায়ক ভদ্রলোকের দুপাশে বাদ্যযন্ত্রের লোক। তারা সবাই বেশ হাসিখুশি। মীরা আছে স্টেজের সামনে। সে দুটা স্পট লাইট নিয়ে ষ্টেজে আলো ফেলার চেষ্টা করছে। একটা স্পট লাইটের আলো পড়বে গায়কের মুখে, অন্য স্পট লাইটের আলো বাদ্যযন্ত্রীদের মুখে। বাদ্যযন্ত্রীরা দুভাগ হয়ে বসেছে বলে একটা স্পট লাইটে হচ্ছে না।
মীরা শুভ্ৰকে দেখল এবং তার কাজ বন্ধ করে হাসিমুখে শুভ্ৰর দিকে এগিয়ে এল। মীরাকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ড্রেস এজ ইউ লাইক খেলায় সে সাদা পরী সেজেছে। সে সেজেছে তাদের বাড়ির সামনের লনের পরীটার বড় বোন। লনের পরীটার একটা পাখী ভাঙ্গা। তার দুটি পাখাই ভাঙ্গা। মীরা পরেছে সাদা শিফনের শাড়ি। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া সাদা আর কানে দুলছে পায়রার ডিমের মত দুটা সাদা পাথর। গলায় ঠিক সেই সাইজের পাথরের মালা। চুল খোঁপা করে বাধা। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। দুই হাতেও চুড়ির মত করে পরা বেলী ফুল।
শুভ্রর কাছাকাছি এসেই মীরা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, এই শুভ্ৰ আমি কি আজ তোকে আসতে বলেছি? [মীরা তার ক্লাসের সবাইকে তুই করে বলে। শুভ্ৰ কাউকেই তুই বলতে পারে না।]
শুভ্র বলল, না।
এত দিন থাকতে বেছে বেছে আজই হুট করে এসে পড়লি কী মনে করে?
আজ কী?
আজ আমার বাবা-মার পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী। আমরা কিছু সিলেক্টেড গেস্টকে বলেছি। তুই সিলেক্টেডদের তালিকায় নেই।
চলে যাব?
এসেছিস যখন এক পিস কেক আর এক কাপ চা খেয়ে যা। গান বাজনা আছে। গান শুনবি?
না।
তাহলে আয় বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ম্যারেজ এ্যানিভার্সরি উৎসবে বাবা খুব মন খারাপ করে থাকেন। এটা খেয়াল রেখে বাবার সঙ্গে কথা বলবি।