জাহানারা আড়াচোখে লক্ষ্য করলেন, বেড়াতে যাচ্ছে অথচ সে পরেছে ইস্ত্রি ছাড়া একটা শার্ট। চুল আঁচড়েছে, কিন্তু আঁচড়ানো ভাল হয় নি। সিঁথি বাঁকা হয়েছে। রিকশা করে যে সে যাচ্ছে, মানিব্যাগ কি সঙ্গে নিয়েছে? আর সঙ্গে নিলেও মানিব্যাগে কি ভাংতি টাকা আছে? দশ টাকা ভাড়া দেবার জন্যে সে হয়ত পঁচিশ টাকার একটা নোট বের করবে। রিকশাওয়ালাকে টাকা ভাঙ্গিয়ে আনতে বলবে। সে টাকা নিয়ে ভোগে চলে যাবে।
জাহানারা শুভ্রর ঘরে ঢুকলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন। তাই। শুভ্ৰ মানিব্যাগ ফেলে গেছে। বিছানার ঠিক মাঝখানে মানিব্যাগ এবং রুমাল পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে শেষ মুহূর্তে সে মানিব্যাগ এবং রুমাল নিতে ভুলে গেছে।
জাহানারা বিনুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিনুকে খুব কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কঠিন কথাগুলি গুছিয়ে নিতে পারলে ভাল হত। কিছু গোছানো নেই। অবশ্য কথা গোছানো থাকারও সমস্যা আছে। তিনি লক্ষ করেছেন গোছানো কথা তিনি প্ৰায় কখনোই বলতে পারেন না।
বিনুর ঘরের দরজা ভেজানো। জাহানারা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। বিনু বিছানায় শুয়েছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল। জাহানারা বিকেলের অস্পষ্ট আলোতেও লক্ষ করলেন মেয়েটার চোখ ভেজা। নিশ্চয়ই শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল। জাহানারা গলার স্বর যতদূর সম্ভব কঠিন করে বললেন, আছর ওয়াক্তে শুয়ে ঘুমাচ্ছ কেন? আছর ওয়াক্তে শুয়ে থাকা যে কতবড় অলুক্ষণে এই শিক্ষা কি বাবা-মা দেয় নাই? নামাজও তো কখনো পড়তে দেখি না। তোমাদের বাড়িতে নামাজের চল নাই? তোমার বাবা নামাজ পড়েন?
বিনু নিচু গলায় বলল, জ্বি পড়েন।
আমারতো মনে হয় না তুমি ঠিক বলছি। আমাদের এখানে যখন এলেন আমি খেয়াল করেছি – মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। তিনি গল্পই করছেন গল্পই করছেন।
বিনু চুপ করে আছে। তার চোখের পানি এখনো বন্ধ হয় নি। জাহানারা লক্ষ করলেন মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করছে এবং চোখের পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। চোখে পানি কেন?— এই প্রশ্ন কি করবেন? জাহানারা বুঝতে পারছেন না।
তোমার বাবাতো আজও এলেন না। ব্যাপারটা কী বলতো? মেয়েকে এখানে ফেলে রেখে মেয়ের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছে। না-কি কারো বাড়িতে গিয়ে গল্পে মজে গেছে। এমন গল্পবাজ মানুষ আমি আমার জীবনে দেখি নি। কী মনে হয়— তোমার বাবা কবে আসবে? না-কি কোনোদিন আসবেই না।
বাবা বৃহস্পতিবার আসবেন।
কী করে বললে? গান গুনে?
বাবার চিঠি পেয়েছি।
বাবার চিঠি পেয়েছ বৃহস্পতিবারে আসবে এই খবরটা আমাকে জানাবে না?
চিঠিটা আজ দুপুরে পেয়েছি।
চিঠিতে কী লিখেছেন?
লিখেছেন বৃহস্পতিবারে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আর বলেছেন আপনাকে সালাম দিতে।
দেখি চিঠিটা।
বিনু অবাক হয়ে তাকাল। জাহানারা বললেন, চিঠিটা দাও দেখি কী লেখা! বাবা নিশ্চয়ই চিঠিতে মেয়েকে এমন কিছু লিখবে না যে সেই চিঠি অন্য কেউ পড়তে পারবে না।
বালিশের নিচ থেকে বিনু চিঠি বের করে দিল। জাহানারা বুঝতে পারছেন চিঠি পড়া উচিত হচ্ছে না। কিন্তু তিনি কৌতূহল আটকাতে পারছেন না। বিনু যে ভর সন্ধ্যায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে তার সঙ্গে বাবার কাছ থেকে আসা চিঠির নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা জানতে ইচ্ছে করছে। মেয়েকে এই বাড়িতে রেখে ইউনিভার্সিটিতে পড়াবে এ ধরনের ইঙ্গিততো চিঠিতে থাকতে পারে। যদি থাকে তাহলে এ বিষয়েও আগে ভাগে ব্যবস্থা নিতে হবে। জাহানারা চিঠি পড়লেন।
আমার অতীব আদরের কন্যা
মোসাম্মত হামিদা বানু (বিনু)
মাগো আমার,
আমার শত সহস্ৰ দোয়া এবং আদর নিও। পর সমাচার এই যে মা— তোমাকে আমি যে যথাসময়ে বাড়িতে নিতে পারি নাই তার জন্যে আমার দুঃখের সীমা নাই। ইনশাল্লাহ আমি আগামী বৃহস্পতিবার দ্বিপ্রহরে চলিয়া আসিব। এবং সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হইব (ইনশাল্লাহ)। মাগো ঢাকায় আসা যাওয়ার ভাড়া জোগাড় করিতে পারি নাই বলিয়া এই সমস্যা হইয়াছে; সব সমস্যার যেমন সমাধান আছে, এই সমস্যারও সমাধান আছে। বুধবার নাগাদ প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা হইবে। এই বিষয়ে তুমি কোনোরকম দুঃশ্চিন্তা করিও না। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
ভাবি সাহেবকে আমার সালাম দিবে। অতি মহীয়সী মহিলা। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গিয়াছে। নিজের মাতার মতই তাহাকে দেখিবে এবং তাহার দোয়া নিবে। মাগো, আমরা অতি দরিদ্ৰ— মানুষের দোয়াই আমাদের একমাত্র সম্বল।
এখন একটা সুসংবাদ দেই— তুমি লিচু গাছের যে চারাটি রোপন করিয়াছিলে সেই চারাতে এই বৎসর মুকুল আসিয়াছে। ইনশাল্লাহ তুমি এই বছর তোমার নিজের রোপন করা গাছের লিচু খাইতে পরিবে। ইহা বিরল সৌভাগ্যের বিষয়। যদিও তোমার মা গাছ কাটাইয়া ফেলিবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করিতেছে, কারণ আমাদের অঞ্চলে প্ৰবাদ আছে যে বসত বাড়িতে লিচু গাছ বাপন করা হয় সেই বাড়িতে বংশে বাতি দিবার কেহ থাকে না। তবে আমার ধারণা ইহা কথার কথা। গাছের সাথে বংশের কোনো সম্পর্ক নাই! তুমি মোটেও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবে না। আমার অতি আদরের কন্যা মোসাম্মত হামিদা বানু যে বৃক্ষ রোপন করিয়াছে আমার জীবন থাকিতে কেহ সেই বৃক্ষের ক্ষতি সাধন করিতে পরিবে না।
দোয়াগো
তোমার পিতা
মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান
মীরাদের বাড়িতে শুভ্ৰ
মীরাদের বাড়িতে শুভ্ৰ এই প্রথম এসেছে। হুলস্থূল ধরনের বাড়ি। মীরাকে দেখে কে বলবে ঢাকা শহরে তাদের এত বড় বাড়ি আছে। অতি সাধারণ শাড়ি পরে সে ইউনিভার্সিটিতে আসে। শুধু শাড়ি না, তার সবকিছুই সাধারণ। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া ডালা থেকে কেনা। কাঁধের চামড়ার ব্যাগটা দেখে মনে হয়। এই ব্যাগ মীরা নিজেই চামড়া কেটে ঘরে বানিয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে যখন থাকে তখন দেখা যায় অফ পিরিয়ড়ে সে নানানজনের কাছে ছোটাছুটি করছে। কেউ তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে যদি এক কাপ চা খাওয়ায়। কোনো মেয়ে হয়ত এক বোতল কোক কিনল, মীরা অবশ্যই বলবে, দেখি এক চুমুক খেয়ে দেখি। সেই মেয়ের এত বড় বাড়ি? একে বাড়ি বলাও তো ভুল- এটা হল রাজপ্রাসাদ।