কী হয়েছে রে, শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, কিছু হয় নি তো। কিছু কি হবার কথা?
এরকম বিম ধরে বসে আছিস কেন?
একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস ভাবছিলাম মা। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামতেই মনে হল— ময়না পাখি শুধু কি মানুষের কথা নকল করে না-কি প্রাকৃতিক শব্দও নকল করে! যেমন ধর বৃষ্টির শব্দ। কিংবা ঝড়ের শব্দ। সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ।
জাহানারা ছেলের খাটের এক কোণায় বসলেন। শুভ্ৰর উদ্ভট উদ্ভট কথা শুনতে তাঁর খুবই ভাল লাগে। উদ্ভট কথাগুলি সে বলে এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে!
তোর যে বাইরে যাবার কথা যাবি না?
যাব।
কখন যাবি?
বৃষ্টি থামলেই যাব। আজ আমার ইচ্ছা করছে হুড খুলে রিকশা করে যেতে। বৃষ্টি থাকলে ভিজে যাব। কাক ভেজা হয়েতো কারোর বাসায় উপস্থিত হওয়া যায় না। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে এইভাবে যেতে।
রিকশা করে যাবি কেন? তোর বাবা গাড়ি পাঠাচ্ছে।
গাড়িতে যাব না মা। তোমাকে কী বললাম, আজ আমার রিকশা করে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। মা তুমি কি একটা কাজ করবে।— বিনুকে বলবে একটু আসতে?
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, কেন?
ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। কী কথা?
কী কথা?
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, কথাটা তোমাকে বলা যাবে না মা। যার কথা তাকেই বলতে হবে। তোমাকে বলা গেলে আমি নিশ্চয়ই বিনুকে ডাকতাম না।
এমন কী কথা যে আমাকে বলা যাবে না?
শুভ্ৰ হাসল। মিষ্টি করে হাসল। জাহানারায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে শুরু করল— বিনুর প্রসঙ্গে ছেলেটা এমন মিষ্টি করে হাসছে কেন? কোনো ঘটনা নেই তো?
জাহানারা গম্ভীর মুখে বললেন, শুভ্ৰ এখন তোকে একটা কথা বলব। না বললেও হত— কিন্তু বলা দরকার। বিনু প্রসঙ্গে একটা কথা।
বল শুনি।
জাহানারা নিচু গলায় বললেন, মেয়েটা ভাল না।
শুভ্ৰ হাসি হাসি মুখে বলল, ভাল না কেন?
ওর অনেক আজেবাজে স্বভাব আছে। আমার কাছে যেটা সবচে খারাপ লাগছে সেটা হচ্ছে – মেয়েটা চোর। বিরাট চোর। গরীবের ঘরে জন্মেছে তো।
শুভ্ৰ যতটা অবাক হবে বলে জাহানারা ভেবেছিলেন সে ততটা অবাক হল না। বরং স্বাভাবিক গলায় বলল, বিনু চোর না-কি? ইন্টারেস্টিং তো! কী চুরি করে?
জাহানারা গুছিয়ে গল্প শুরু করলেন। শুভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তবে তার মুখ হাসি হাসি।
জাহানারা চাপা গলায় বললেন, খাবার ঘরের টেবিলে চায়ের কাপে চাপা দিয়ে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট রেখেছিলাম দুধের বিল দেব বলে। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখি নোট তিনটা নেই। শুধু দুধের বিলটা আছে। কাজের মেয়েটা ছুটিতে। ঘরে মানুষ বলতে- তুই, আমি আর বিনু বাতাসে নোট তিনটা উড়ে জানালা দিয়ে চলে যায় নি। যদি যেত দুধের বিলটাও যেত। দুধের বিল ঠিকই আছে, নোট তিনটা নেই। টাকাটা নিলে হয় আমি নেব, নয়ত তুই নিবি, কিংবা বিনু। তুই নিশ্চয় টাকা নিয়ে যাস নি।
শুভ্ৰ হাসছে। শব্দ করে হাসছে। যেন জাহানারা এই মাত্র মজার কোনো গল্প বলে শেষ করেছেন। জাহানারা রাগী গলায় বললেন, তুই হাসছিস কেন?
তুমি বানিয়ে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলছ— এই জন্য হাসছি। তোমার ফেব্রিকেটেড লাইনগুলি খুবই হাস্যকর হয়।
জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, বানিয়ে গল্প বলছি মানে?
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, মা আজ হচ্ছে মাসের ২৮ তারিখ। আজ তুমি দুধের বিল দেয়ার জন্যে টাকা বের করবে না। এটা ৩১-এ মাস, দুধওয়ালা দুধের বিলই দেয় নি।
জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। শুভ্র খুব সহজ গলায় বলল, মা আমি খুব ছোটবেলা থেকে লক্ষ করছি— তুমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বল। এবং এক সময় তোমার বানানো কথা তুমি নিজে বিশ্বাস করতে শুরু করা। আমার মনে হয় এটা তোমার এক ধরনের অসুখ।
জাহানারা যন্ত্রের মত বললেন, আমার অসুখ?
হ্যাঁ অসুখ। আমি যখন ক্লাশ গ্ৰীতে পড়ি তখন স্কুলের সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। চশমা ভেঙ্গে গিয়েছিল। চশমার কাচে কপাল কেটে গিয়েছিল। তুমি সবাইকে বলেছ- রিকশায় করে বাসায় ফেরার সময় আমি এ্যাকসিডেন্ট করেছি। পেছন থেকে একটা প্ৰাইভেট কার ধাক্কা দিয়ে আমার রিকশা ফেলে দিয়েছে। কত বছর আগের ব্যাপার অথচ এই ঘটনা সেদিনও তুমি আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের বললে।
কখন বললাম?
আমার হাম হয়েছিল। সবাই দলবেঁধে আমাকে দেখতে এসেছিল, তখন বললে।
যখন বলেছিলাম। তখন তুই আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলি না কেন? তখন কেন বললি না— আমার মা মিথ্যে কথা বলছে। আমার মা মিথ্যাবাদী।
শুভ্র বলল, মা তুমি রাগ করছ?
জাহানারা কোঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলবি আর আমি রাগ করতে পারব না? তুই চুপ করে বসে থাক, নড়বি না। আমি দুধের বিল নিয়ে আসছি। এই নতুন দুধওয়ালা প্রতি মাসেই পঁচিশ-ছাব্বিশের দিকে দুধের বিল দিয়ে দেয়। এখন আমি ডেইরি ফার্ম থেকে দুধ নিচ্ছি। ওরা খুব নিয়মকানুন মেনে চলে।
শুভ্ৰ বলল, একটা মিথ্যা বললে পরপর অনেকগুলি মিথ্যা বলতে হয় মা। তুমি দুধওয়ালা বদলাও নি, আগের দুধওয়ালাই দুধ দিচ্ছে। গতকালও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
আচ্ছা যা আমি মিথ্যাবাদী। এখন আমাকে কী করতে হবে? তোর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না, বিনুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে?
শুভ্র বিব্রত গলায় বলল, মা শোন, তাকাও আমার দিকে।
জাহানারা তাকালেন না। ছেলের ঘর থেকে উঠে চলে এলেন। তাঁর মনে আশা ছিল শুভ্ৰ তাঁর পেছনে পেছনে উঠে আসবে। শুভ্র তা করল না। জাহানারা খুবই অবাক হয়ে দেখলেন বৃষ্টি থামা মাত্র শুভ্ৰ বের হয়ে গেল।