মোতাহার সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, গাড়ি নিয়ে যাও। টাকা ক্যাশ করে নিজের কাছে রেখে দিও। আমাকে দেয়ার দরকার নেই। আমি পরে চেয়ে নেব। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
কাজ শেষ করে গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দিও। শুভ্ৰ কোথায় যেন যাবে।
জ্বি আচ্ছা। স্যার আপনার কি শরীর বেশি খারাপ?
মোতাহার সাহেব জবাব দিলেন না। মঞ্জু, দ্বিতীয় চায়ের কাপ এনে সামনে রেখেছে। সে বড় সাহেবের দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছে। মোতাহার সাহেব চায়ের কাপের দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি বারবার নাক কুঞ্চিত করছেন। তিনি দুৰ্গন্ধ এখনো পাচ্ছেন। তবে এখন আগের চেয়ে কিছু কম। সিলিং ফ্যানের খট খটক শব্দটাও এখন আর আগের মত কানো লাগছে না।
তিনি বিছানায় শুতে গেলেন- কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে যদি শরীর ভাল লাগে। মঞ্জু মশারি খাটিয়ে দিল। সে হাত বাড়িয়ে পায়ের আঙ্গুল টানতে শুরু করেছে। মোতাহার সাহেব ঘুমুতে চেষ্টা করছেন। ঘুম আসছে না। এতক্ষণ মাথা ঘুরছিল না। এখন মাথাও ঘুরছে। এটা হচ্ছে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে। অসুস্থ অবস্থায় ঘুরন্ত কোনো কিছুর দিকে তাকাতে নেই। বাইরের ঘূর্ণিমাথার ভেতর ঢুকে যায়। তিনি মঞ্জুকে ফ্যান বন্ধ করতে বললেন। মঞ্জু লাফ দিয়ে উঠে। ফ্যান বন্ধ করল। তখন তাঁর গরম লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে তিনি ভদ্র দুপুরে নৌকার ওপর ছাতা ছাড়া বসে আছেন। রোদের ঝাঁঝাঁটা পড়ছে মাথায়। নদীর পানির গরম ভাব মুখে লাগছে! সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৌকার দুলুনি। মঞ্জুকে তিনি আবার ফ্যান চালু করতে বললেন। মঞ্জু ফ্যান চালু করল। তিনি অসহিষ্ণু গলায় বললেন, মঞ্জু স্পীড বাড়িয়ে দে। বাতাস লাগছে না।
মঞ্জু ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে সঙ্কুচিত গলায় বলল, বড় সাহেব একজন ডাক্তার ডেকে আনি?
মোতাহার সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দরকার নাই; তুই আমাকে ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি এনে দে। বরফ দিয়ে খুব ভাল মত ঠাণ্ড করে আনবি।
মঞ্জু পানি নিয়ে এসে দেখে বড় সাহেব। ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে খুব সাবধানে পানির গ্রাস টেবিলে রেখে বের হয়ে গেল। বড় সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর ঘুম ভাঙ্গানো নিষেধ। শুধু নিষেধ না, কঠিন নিষেধ। তখন জরুরি টেলিফোনও আঁকে দেয়া যায় না। বলা আছে, শুধু যদি ছোট বাবু টেলিফোন করেন। তবেই তাঁর ঘুম ভাঙ্গানো যাবে। তবে ছোট বাবু কখনো টেলিফোন করেন না। মঞ্জুর কি উচিত বড় বড় সাহেবের বাড়িতে টেলিফোন করে তাঁর অসুখের খবরটা দেয়া? উচিত তো বটেই, কিন্তু সমস্যা আছে। অফিসের কারোরই কোনো অবস্থাতেই বড় সাহেবের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি নেই। বৎসর খানেক আগেই এই সামান্য কারণে একজনের চাকরি চলে গিয়েছিল। তার অপরাধ হলো সে টেলিফোনে জানতে চেয়েছিল— বড় সাহেব কখন অফিসে আসবেন।
জাহানার আছরের নামাজে বসার প্রায় সাথে সাথে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। তিনি তখন সূরা ফাতেহার মাঝামাঝি। তিনি খুবই অস্থির বোধ করলেন। এই বাড়িটা এমন যে বৃষ্টি এলেই পূর্ব দিকের বারান্দার গ্ৰীল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে। রান্নাঘর আর শুভ্ৰর ঘরে পানি থৈথৈ করতে থাকে। শুভ্ৰ তাতে খুবই মজা পায়। তিনি অস্থির বোধ করেন।
বাড়িতে দুদিন ধরে কোনো কাজের লোক নেই যে, এরা বুদ্ধি করে জানালা বন্ধ করবে। আর শুভ্র এমন ছেলে যে হা করে বৃষ্টি দেখবে— জানালা বন্ধ করবে: না। তারপর বৃষ্টির পানিতে নিজেই হোঁচটি খেয়ে পড়বে।
নামাজ ছেড়ে উঠে যাওয়া ঠিক হবে না— বড় রকমের গুনাহর কাজ হবে। জাহানারা অতি দ্রুত সূরা শেষ করতে চেষ্টা করলেন। এতে সব কিছু আরো জন্ট পাকিয়ে যেতে লাগল। সূরা ফাতিহা আবার প্রথম থেকে ধরলেন। সূরা শেষ করার আগেই মনে হল— প্রথম রাকাতটা কি পড়া হয়েছে? না, হয় নি। একই সঙ্গে বৃষ্টি কোন দিকে থেকে আসছে তিনি ধরতে চেষ্টা করছেন। উত্তর দিক থেকে এলে তেমন সমস্যা নেই। কারা যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিনু হাঁটছে। মেয়েটার মতলবটা কী? বৃষ্টি হচ্ছে জানালা বন্ধ করতে হবে এই অজুহাতে সে শুভ্রর ঘরে ঢুকে যাবে নাতো? যে সব গ্রামের মেয়ে শহরে পড়তে আসে তারা তলে তলে হাড় বজ্জাত হয়। মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু আখের গোছাতে তারা ওস্তাদ। তারচেয়েও ওস্তাদ অজুহাত তৈরি করতে। রাত তিনটার সময়ও যদি এই মেয়েকে শুভ্রর ঘরে পাওয়া যায়। সে শুকনো মুখে এমন এক অজুহাত দেবে যে মনে হবে। রাত তিনটায় শুভ্ৰর ঘরে থাকা খুব প্রয়োজন ছিল। তিনি হয়ত তার জন্যে বিনুকে ধন্যবাদও দেবেন। শুভ্ৰর সঙ্গে এই মেয়ের ভালই যোগাযোগ আছে। এটা থাকবেই। এই মেয়ে শুভ্রর মত ছেলেকে যে-কোনো মূল্যে হাতে রাখবে।
জাহানারার নামাজে গণ্ডগোল হয়ে গেলা— তিনি সিজদায় গিয়ে আত্তাহিয়াতু পড়লে শুরু করলেন। ভুল নামাজ চালিয়ে যাবার অর্থ হয় না। তিনি নামাজ বাদ দিয়ে উঠে পড়লেন। মাগরেবের সময় কাজা পড়ে নিলেই হবে। ভুলভাল নামাজ পড়তে সোয়াবের চেয়ে গুণ বেশি হয়। দরকার কী?
বৃষ্টি পূর্ব দিক থেকেই এসেছে। তবে ঘরে পানি ঢুকে নি। এতক্ষণ ঘরে যে হাঁটাহাঁটির শব্দ শুনছিলেন সেটাও কানের ভুল। বিনুর ঘর বন্ধ; শুভ্রর ঘরাও বন্ধ।
তিনি শুভ্রর ঘরের দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। সব কটা জানোলা বন্ধ। শুভ্র ইজিচেয়ারে মূর্তির মত বসে আছে। খুবই অস্বাভাবিক দৃশ্য। বৃষ্টি হবে। আর শুভ্র জানালা খুলে বৃষ্টি দেখবে না, এটা হতেই পারে না।