এতেই চলবে, শরীর ফ্রেশ লাগছে। এগারো মিনিটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন দেখেছি। ইন্টারেস্টিং এবং ভয়াবহ।
কী স্বপ্ন?
আমি একটা ঠেলাগাড়িতে বসে আছি। দুজন মহিলা ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পেছনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি। তাও ভালোমতো না। কারণ আমি যতবার মহিলার দিকে তাকাই, উনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। এই হলো স্বপ্ন।
আমি বললাম, ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন ঠিকই আছে। ভয়াবহ তো না।
অবশ্যই ভয়াবহ। দুজন মহিলার কারোর গায়েই কাপড় নেই। একগাছা সুতাও নেই। আমার গায়েও কাপড় নেই। অথচ রাস্তার সবার পরনে কাপড়। সবাই আমাদের দেখে মজা পাচ্ছে– হাসছে। এখন বল, স্বপ্নটা ভয়াবহ না?
হুঁ।
জহির ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। আমার শার্টের পকেটে ঠিকানা লেখা কাগজ আছে। সেই ঠিকানায় যেতে হবে। বিকাল ছটা বাজে। সূর্য ড়ুববে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। সেই সময় ঘর থেকে বের হতে নেই। ঘর ছেড়ে বের হতে হলে আগেই বের হতে হবে।
দরজার পাশে কলিংবেল আছে
দরজার পাশে কলিংবেল আছে। কলিংবেলের নিচে স্কচ টেপ দিয়ে সাঁটা নোটিশ–
হাত দিলে শক খাইবেন
বেল নষ্ট
আমি দরজার কড়া নাড়লাম। ঢাকা শহর থেকে কড়া বসানো দরজা উঠে গেছে বলেই জানতাম— এখানে আছে। চিপা ধরনের লিফট ছাড়া ফ্ল্যাট বাড়ি। গরিবদের জন্যে আজকাল এক বেডরুমের কিছু ফ্ল্যাট বানানো হচ্ছে। এটাও নিশ্চয়ই এরকম কিছু। সিঁড়িতে রেলিং বসানো শেষ হয় নি, এর মধ্যেই লোকজন উঠে গেছে।
ফ্ল্যাট নাম্বার আটের খ। দরজায় প্লাস্টিকের অক্ষরে বাড়িওয়ালা কিংবা ভাড়াটের নাম—
আবুল কালাম মিয়া
অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেটদের এমন দৈন্যদশা জানতাম না। আমি খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেছি। ভাইয়া এই ঠিকানা কাগজে লিখে দিয়েছে। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে ঠিকানাটা ভুল। দরজার কড়া নাড়লেই অ্যাডভোকেট সাহেব বের হবেন এবং থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করবেন, কী চাই?
ভুল ঠিকানা নিয়ে এসেছি বললেও যে অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে তা মনে হয় না। তিনি অবশ্যই নানান প্রশ্ন করবেন—
ভুল ঠিকানাটা কে দিয়েছে? তার নাম, তার পরিচয়? তোমার নাম? তোমার পরিচয়? ঠিকানা কী?
আমি কড়া নাড়লাম। কলিংবেল টিপতে হয় একবার, কড়া নাড়তে হয় থেমে থেমে তিনবার। আমাকে তিনবার নাড়তে হলো না। দ্বিতীয় বারেই দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে হলুদ লুঙ্গি। গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি। মুখ হাসি হাসি। যেন তিনি আমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।
আরে বাবলু তুই? আয়, ভেতরে আয়।
বাবা ভেতরের দিকে মুখ করে আনন্দিত গলায় বললেন, এই দেখ বেএসেছে।
বসার ঘরের মেঝেতে তিন সাড়ে তিন বছরের একটা মেয়ে বসে আছে। তার চারদিকে সস্তার খেলনা ছড়ানো। সামনে একটা টেবিল ফ্যান। মেয়েটির স্বভাব মনে হয় প্রতিধ্বনির মতো যা শুনছে তাই নিজের মতো করে বলা। সে খেলনা থেকে চোখ না সরিয়ে রিনরিনে গলায় বলল, এই দেখ কে এসেছে।
বাবা আমার হাত ধরে ঘরের ভেতর টানতে টানতে বললেন, বাবলু এসেছে। বাবুল।
ছোট মেয়েটা বলল, বাবলু এসেছে, বাবলু।
বাবা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, বাবলু কী রে? নাম ধরে ডাকা বেয়াদব মেয়ে। তোর ভাই হয়। ভাইয়া ডাকবি।
মেয়েটা বিড়বিড় করে বলল, ভাইয়া।
রান্নাঘর থেকে অল্পবয়স্ক, আঠারো-উনিশ কিংবা তারচেয়ে কমও হতে পারে, একজন মহিলা উঁকি দিলেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।
বাবা বললেন, হা করৈ তাকিয়ে আছ কেন? এই হলো বাবলু, My son. দেখেছ কী সুন্দর চেহারা!
মহিলা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিলেন। বাবা বললেন, তুই যে একদিন না একদিন আসবি আমি জানতাম। তুই আরাম করে বস তো। যূথী মা, ভাইয়ার দিকে ফ্যানটা দিয়ে দাও।
যূথী ফ্যান আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল, আর তখনি মঞ্চে যার আবির্ভাব হলো তাকে আমি চিনি— আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জিতুর মা। গোশতের শুঁটকির টিন নিয়ে সে এই বাসায় উঠেছে, এখন বুঝতে পারছি। জিতুর মা আহ্লাদী গলায় বলল, ও আল্লা, ভাইজান! কেমন আছেন? বাসার সবেই ভালো? আম্মাজানের আধ কপালী মাথাব্যথা এখনো হয়?
বাবা বললেন, জিতুর মা, ফালতু বাত বন্ধ কর। বাবলু রাতে খাবে, এই ব্যবস্থা দেখ। টাকা নিয়ে যাও, হাফ কেজি খাসির মাংস নিয়ে আস। আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি–তোমার যেতে হবে না। মাংস চিন না কিছু না। ভেড়ার মাংস নিয়ে আসবে, বোটকা গন্ধের জন্যে মুখে দেয়া যাবে না। বাবলু, তুই দশ মিনিট বসে থাকতে পারবি না?
পারব।
যূথীর সঙ্গে বসে গল্প কর। আমি রিকশা নিয়ে যাব, রিকশা নিয়ে ফিরব। দশ মিনিটও লাগবে না। তুই বসে বসে চা খা। তোর চা শেষ হবার আগেই আমি চলে আসব।
আমিও যাই তোমার সঙ্গে?
কোনো দরকার নেই, তুই যূথীর সঙ্গে গল্প কর।
আমি এবং যূথী বসে আছি। মেয়েটার চেহারা যে এত মায়াকাড়া আগে বুঝতে পারি নি। গোলগাল রোগা মুখে বড় বড় চোখ। চোখের মণি ঝলমল করছে। গায়ের রঙ একটু ময়লা। তাকে এই রঙটাই মানিয়েছে। এই মেয়েটা ফর্সা হলেও মানাতো না। কালো হলেও মানাতো না। তার মাথার চুল বেণি করা। দুদিকে দুটা বেণি ছিল। একটা খুলে গেছে, এতেই মেয়েটাকে ভালো লাগছে। দুই বেণিতে একে মানাতো না। আমি বললাম, যূথী, তুমি কেমন আছ?