জহির ভাইকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তিনি টাকা হাতে নেন নি। বিরক্ত মুখে বলেছেন, ম্যাগাজিনটার নিচে রেখে দে। টাকা দিয়েছে কে?
ভাইয়া।
সাতদিনের মধ্যেই টাকা ফেরত দিব। তখন মনে করে যার টাকা তাকে দিয়ে দিবি।
আচ্ছা।
জহির ভাই বসে আছেন আমার ঘরে। আমার ঘর বলা ঠিক হচ্ছে না, আমাদের ঘর বলা উচিত। জহির ভাই আমার সঙ্গে থাকেন। এই ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট পাতা। তবে এখানে তিনি থাকেন না বললেই হয়। তার স্থায়ী ঠিকানা এখন দি ইমেজ।
বাবলু!
কী জহির ভাই।
এই দুই হাজার নিয়ে আমার কাছে এখন টোটাল ক্যাশ টাকা কত আছে জানিস?
না।
আন্দাজ কর।
পাঁচ হাজার?
পঁয়তাল্লিশ হাজার।
এত টাকা?
পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা বাংলাদেশে এখন কোনো টাকাই না। সদরঘাটে ভিক্ষা করে যে ফকির তাঁর কোচড়েও এই টাকা থাকে। একটা জার্মান লুগার পিস্তলের দাম সত্ত্বর হাজারের ওপরে। চাইনিজ পিস্তলের দাম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার।
তুমি কি পিস্তল কিনবে?
জহির ভাই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন। এখন তার চোখে মুখে বিরক্তি নেই। তাঁকে আনন্দিতই মনে হচ্ছে।
বাবলু!
জি জহির ভাই।
তোর এখানে রাতে ঘুমাই না কেন বল তো?
জানি না।
অনুমান কর।
ঘরটা ছোট, সিলিং ফ্যানে শব্দ হয়। শব্দে তুমি ঘুমাতে পার না।
হয় নি। তোর ওপরে আমার আছর হোক, এটা চাই না বলেই তোর সঙ্গে ঘুমাই না। ঘুমের সময় আত্মা ফ্রি হয়ে যায়। একজনের আত্মার সঙ্গে আরেকজনের মিলমিশ বেশি হয়। আছরও বেশি পড়ে। তুই যদি সাতদিন কোনো ক্রিমিন্যালের সঙ্গে ঘুমাস, অষ্টম দিনে তুই নিজেও ক্রিমিন্যাল হয়ে যাবি।
তুমি কি ক্রিমিন্যাল?
এখনো জানি না। পিস্তল হাতে আসুক, তারপর বুঝব।
মানুষ মারবে?
হুঁ।
কাকে মারবে?
জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, প্রথম ধরা খাবে দি ইমেজের মালিক– আমার প্রাণপ্রিয় দোস্ত, ফারুক ভাইজান।
উনি কী করেছেন?
উনি কী করেছেন তোর জানার দরকার নাই। এই জগতের নিয়ম যত কম জানবি তত সুখে থাকবি। পিঁপড়া সবচে কম জানে বলে সে মহাসুখে আছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিঁপড়ার চেয়ে একটু বেশি জানে উইপোকা। উইপোকাকে কী করতে হয়? আগুন দেখলেই তাকে উড়ে আগুনের কাছে যেতে হয়। উইপোকা যদি কম জানতো তাহলে তাকে আগুনে পুড়ে মরতে হতো না। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
পনের মিনিট ঘুমাব, বুঝতে পারছিস?
পারছি।
ঘড়ি হাতে নিয়ে বসে থাক। ঠিক পনের মিনিট পরে আমাকে ডেকে তুলবি। তোর ঘড়ি আছে না?
না।
ঠিক আছে তোকে একটা দামি ঘড়ি দেব। আপাতত আমার ঘড়ি হাতে বসে থাক। ঠিক পনের মিনিট পরে ডাকবি। পনের মিনিটের জায়গায় যদি ষোল মিনিট হয়, কনুইয়ের গুতা খাবি। জায়গা মতো কনুইয়ের গুতা দিলে যে মানুষ মরে যায়, এটা জানিস?
না।
মানুষের শরীরে কয়েকটা দুর্বল জায়গা আছে, সেখানে গুতা লাগলে শেষ। কলমা পড়ার সুযোগও পাবে না।
জহির ভাই তাঁর হাতঘড়ি খুলে আমার হাতে দিলেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, আমি কাউন্টিং শুরু করতে বললেই কাউন্টিং শুরু করবি।
আচ্ছা।
মা না-কি আজকাল ভূত-প্রেত দেখা শুরু করেছে, এটা সত্যি?
হুঁ।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।
সত্যিও তো হতে পারে।
হতে পারে। There are many things in heaven and earth… কার কথা বল দেখি?
শেক্সপিয়ারের।
জানলি কী ভাবে?
তুমি আগে একবার বলেছিলে—
ভেরি গুড। হ্যামলেটে আছে। Ok, start counting.
জহির ভাই পাশ ফিরলেন। আমি তাকিয়ে আছি ঘড়ির দিকে। জহির ভাই বিষয়ে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি— জহির ভাইও খুব ভালো ছাত্র। ভাইয়ার মতো না হলেও বেশ ভালো। এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই স্টার পাওয়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলেন। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় তাঁর সত্ত্বাবা (আমার বড়খালু) রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন। তখন খালা বললেন, জহিরের পড়ার খরচ আমি দিব কেন? ও তো ফকিরের পুলা। আমার ছেলে তো না। ফকিরের পুলার পিছনে আমি কেন পয়সা নষ্ট করব? আমার স্বামী নাই, প্রতিটা পাই পয়সা আমাকে হিসাব করে খরচ করতে হয়। ফকিরের পুলার পিছনে আমি আর একটা পয়সা খরচ করব না।
জহির ভাই তখন খালাকে বললেন, আমি তাহলে কী করব?
খালা বললেন, তুই তোর বাপ মারে খুঁজে বের কর। পরের ঘাড়ে আর কতদিন বসে থাকবি?
আলোচনার এই পর্যায়ে বাবা বললেন, বড়আপা, আপনারা একসময় আগ্রহ করে এই ছেলেকে পালক এনেছেন। এখন হঠাৎ করে…
বড়খালা বললেন, তোমার যদি এত দরদ থাকে তুমি পাল। তুমি তার পড়ার খরচ দাও।
বাবা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, কষ্ট টষ্ট করে খরচ আমিই দিব। অনার্সটা পাশ করে ফেললে চাকরির চেষ্টা করা যাবে। বড় বড় লোকজন আমার পরিচিত। আব্দুল গনি নামে একজন আছে, পুরান ঢাকায় রিয়েল স্টেট করে কোটিপতি হয়েছে। তার সঙ্গে একসময় একখাটে ঘুমাতাম। তাকে গিয়ে যদি বলি— গনি! ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করে দাও। সে আমার কথা ফেলতে পারবে না। তার অসংখ্য ফার্ম। কোনো একটার ম্যানেজার বানায়ে দিবে। পোস্ট থাকলে পোস্ট ক্রিয়েট করবে। এইটুকু আমার জন্যে তাকে করতেই হবে।
আমাকে ডাকতে হলো না। পনের মিনিট পার হবার আগেই জহির ভাই উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?
আমি বললাম, এগারো মিনিটেরও কম।