আমি কিছুক্ষণ নীলা ফুপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে পনেরশ টাকা ধার দিতে পারবে?
কী করবি?
আমি একজনকে দেব। আমার কাছে চেয়েছে।
সেই একজনটা কে?
জহির ভাই।
আমার কাছে টাকা নেই।
টাকা নেই, তাহলে এত কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? টাকা দিয়ে কী করবি? কাকে ধার দিবি?
জানার জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। যা এখন ভাগ। সেদিনের ছেলে, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছে!
আমি নীলা ফুপুর সামনে থেকে বের হলাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সিক্সথ সেন্স আমাকে বলছে টাকা পাওয়া যাবে না। যার কাছে যাব সে-ই বলবে না। মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে।
বাবলু, একটু শুনে যা তো।
আমি তাকিয়ে দেখি ভাইয়া তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরের দরজা খোলা। খুবই অস্বাভাবিক দৃশ্য, ভাইয়ার ঘরের দরজা কখনো খোলা থাকে না।
একতলার সবচে শেষের ঘরটা ভাইয়ার। ঘরটা ছোট। ঘরের একটাই জানালা, সেই জানালাটাও ছোট। জানালা ঘেঁসে বিশাল একটা পেয়ারা গাছ উঠেছে। গাছে এখন পর্যন্ত কোনো পেয়ারা হয় নি। এই গাছটা নাকি পুরুষ। পুরুষ পেয়ারা গাছের কারণে ভাইয়ার ঘরের জানালা দিয়ে কোনো আলো ঢুকে না। এটাই ভাইয়ার পছন্দ। তাঁর ঘর অন্ধকার থাকতে হবে। তার ঘরে কেউ ঢুকতে পারবে না। ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্যেও না। ভাইয়া তাঁর নিজের ঘর নিজে গোছায়। যে-কেউ ভাইয়াকে দেখলেই বুঝবে সে একজন অস্বাভাবিক মানুষ।
অস্বাভাবিক তো বটেই। এসএসসি পরীক্ষায় ভাইয়া ঢাকা বোর্ডের সব ছেলেমেয়ের মধ্যে থার্ড হয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েটে হয়েছে ফোর্থ। ফিজিক্স অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড। এমএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনো রেজাল্ট হয় নি। উড়া উড়া শুনতে পাচ্ছি, রেজাল্ট হবার আগেই ভাইয়া পিএইচডি করতে আমেরিকা যাবে। এই বিষয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু শুনি নি। ভাইয়া তার নিজের বিষয়ে কখনো কাউকে কিছু বলে না।
বাবলু বোস, খাটের ওপর বোস।
আমি বসলাম। ভাইয়া আমার সামনে চেয়ারে বসল।
লজেন্স খাবি? হরলিক্সের কৌটায় লজেন্স আছে। নিয়ে খা। আমাকেও একটা দে।
আমি লজেন্স নিলাম। ভাইয়াকে একটা দিলাম।
রাত জেগে পড়ি তো, তখন ব্রেইন প্রচুর সুগার খরচ করে। শরীরে সুগারের ঘাটতি পড়ে। তখন লজেন্স খাই।
আমি লজেন্স চুষছি। ইচ্ছা করছে লজেন্সটা দাঁত দিয়ে ভেঙে গুঁড়া করে ফেলতে। কড়মড় শব্দ হবে। ভাইয়া হয়তো বা বিরক্ত হবে, এই ভয়ে পারছি না।
বাবলু।
হুঁ।
শরীরের রক্তের তিন ভাগের এক ভাগ যে ব্রেইন নিয়ে নেয়, এটা জানিস?
না।
ব্রেইনেরই অক্সিজেন সবচে বেশি দরকার।
ও।
আমার কাছে একটা বই আছে, নাম বোকাওয়ার্স ব্রেইন। পড়ে দেখতে পারিস। মজা পাবি।
ইংরেজি পড়তে পারি না ভাইয়া
ইংরেজি পড়তে না পারার কী আছে? একটা ডিকশনারি নিয়ে বসবি। অজানা শব্দগুলির মানে ডিকশনারিতে দেখে নিবি। ভোকাবলারি বাড়বে।
আচ্ছা।
এখন তোর খবর কী বল?
আমি হুট করে বলে ফেললাম, আমাকে পনেরশ টাকা দিতে পারবে ভাইয়া।
কত?
পনেরশ।
তোষকের নিচে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ থেকে নিয়ে নে।
আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা নিলাম। হরলিক্সের কৌটা থেকে আরেকটা লজেন্স নিলাম। এই লজেন্স কড়মড় করে ভেঙে খাব। ভাইয়া বিরক্ত হলে হবে।
বাবলু, তোকে একটা কথা বলার জন্যে ডেকেছি। তোর সঙ্গে তো বাবার খুব খাতির। বাবা যে আরেকটা বিয়ে করেছে এটা জানিস? বাবা তোকে কিছু বলেছে?
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, না!
বিয়ে করেছে চার বছর আগে। ঐপক্ষে তার একটা মেয়েও আছে। মেয়ের নাম যূথী।
আমি কড়মড় করে লজেন্স ভাঙলাম। ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো না লজেন্স ভাঙার শব্দ তার কানে গেছে।
ঘটনাটা আমি জানি আর মা জানে। বাবা আর ঐ মেয়ে একটা ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। তোকে ঠিকানা দিচ্ছি, তুই ভেরিফাই করে আসবি।
এখন যাব?
না, এখন না। একটু রাত করে যা।
ভাইয়ার ঘর থেকে বের হয়ে দেখি মা বারান্দায় মোড়ার ওপর বসেছেন। মাথাটা উঠানের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। নতুন একটা কাজের মেয়ে মার মাথায় পানি ঢালছে। এটা নতুন কোনো দৃশ্য না। প্রায়ই মার মাথা গরম হয়ে যায়, তখন তাঁর মাথায় পানি ঢালতে হয়। কাজের মেয়েটিকে দেখে মনে হলো, পানি ঢালার কাজটায় সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। একহাতে জগে করে পানি ঢালছে অন্যহাতে মাথায় থাবড়া দিচ্ছে। থাবড়া দেয়ার সময় তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে।
মা আমাকে দেখেছেন। তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। বাবা বিষয়ে কোনো কথা বলবেন কি-না বুঝতে পারছি না। কাজের মেয়ের সামনে বলার কথা না— তবে উচিত অনুচিত নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ তিনি না। আমি কাছে গেলাম। মা ভাঙা গলায় (মার গলা কখনো ভাঙে না, তবে যে-কোনো সময়ে তিনি দুঃখের কথা ভাঙা গলায় বলতে পারেন। আমার সঙ্গে ভাঙা গলায় কথা বলে তার পরপরই অন্য একজনের সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বলবেন। এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।) বললেন, খোকনের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিস?
হুঁ।
আমার স্যান্ডেলটা সাথে করে নিয়ে যা। যদি দেখিস ঘটনা সত্যি, আমার স্যান্ডেলটা দিয়ে তোর বাপকে দশটা বাড়ি দিবি। পারবি না? অবশ্যই আমার স্যান্ডেল নিয়ে যাবি। স্যান্ডেল না নিয়ে গেলে তুই আমার কু পুত্র। তোকে আমি পেটে ধরি নাই। অন্য কোনো মাগি তোকে পেটে ধরেছে।…
মা হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার ভাঙা গলা ঠিক হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা মার কথা শুনেও মজা পাচ্ছে। সে মুখ আড়াল করে হাসার চেষ্টা করছে। তার হাসির শব্দ মার কানে গেলে বিপদ আছে। মা কাজের মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে খুব পছন্দ করেন।