জহির ভাই ডিভানে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে তার ঘুম ভেঙেছে। চোখে-মুখে এখনো ঘুম লেগে আছে। তার কানের ওপর একটা সিনেমা ম্যাগাজিন। একহাতে সিগারেট অন্য হাতে ম্যাচ। সিগারেট এখনো ধরানো হয় নি। ঘুম কাটলেই সিগারেট ধরাবেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাই তুললেন। আমি বললাম, নাশতা করেছ?
জহির ভাই বিরক্ত গলায় বললেন, না।
চল নাশতা করে আসি।
টাকা আছে?
হুঁ।
পাঁচশ পনের।
জহির ভাই আবারো হাই তুললেন। সিগারেট ধরালেন। বিরক্ত ভঙ্গিতে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমার সন্ধ্যার মধ্যে দুই হাজার টাকা দরকার। মাকে বলে টাকা জোগাড় করে দে।
আমি চাইলে দিবে না। তুমি চেষ্টা করে দেখ।
আমাকেও দিবে না। তোর নীলা ফুপুর কাছে আছে? নাটক-ফাটক করে যখন টাকা থাকার তো কথা।
থাকতে পারে।
চেষ্টা করে দেখবি?
চেষ্টা করতে পারি। এই পাঁচশ রাখ।
খুচরা-খাচরা নিয়ে লাভ নাই। পুরা দুই হাজার জোগাড় করতে পারলে দিবি, না পারলে নাই। ফ্লাক্স নিয়ে যা, আমার জন্যে চা নিয়ে আয়।
বাসার চা, না দোকানের চা? মজিদের দোকানের চা। মজিদকে বলবি যেন স্পেশাল করে বানায়।
জহির ভাই শুয়ে পড়লেন। ম্যাগাজিন খুলে বুকের ওপর ধরলেন। তার দুই হাতে ম্যাগাজিন ধরা, ঠোঁটে সিগারেট। তিনি হাত দিয়ে সিগারেট ধরছেন না। মাঝে-মাঝে মাথা ঝাকি দিচ্ছেন সিগারেটের ছাই ফেলার জন্যে। ছাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি নির্বিকার।
আমি জহির ভাইকে খুবই পছন্দ করি। কেন করি নিজেও জানি না। পছন্দ করার মতো তেমন কোনো গুণ তার নেই। অপছন্দ করার মতো অনেক কিছুই আছে। কোনো মানুষই সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ করে থাকতে পারে না। জহির ভাই পারেন। কেউই ময়লা কাপড় পরতে পছন্দ করে না, জহির ভাই করেন। তার সার্বক্ষণিক পোশাক স্যান্ডেল, জিনসের প্যান্ট এবং হলুদ শার্ট। শার্টে ময়লা জমতে জমতে ছাতা পড়ে গেছে। হলুদ শার্ট এখন আর হলুদ না— কালচে সবুজ।
সমস্যা হচ্ছে, সেই নোংরা কাপড়েও তাকে মানায়। তাঁর চেহারা রাজপুত্রের মতো। ময়লা জামা-কাপড়ে তিনি যখন বের হন তখন মনে হয় ছবির শুটিং হচ্ছে। ছবির নায়ক ভ্যাগাবণ্ড সেজে অ্যাকটিং করছে। জহির ভাইকে নিয়ে একটা মজার গল্প বললে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। তিনি আর আমি মোহাম্মদপুর বাজারে গিয়েছি। মাসের বাজার করা হবে। চাল, ডাল, তেল এইসব কেনা হবে। জহির ভাইয়ের মেজাজ খুবই খারাপ। তিনি বললেন, বাজার সদাই যা করার তুই করতে থাক। আমি এর মধ্যে নেই। আমি এখানে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকব। বাজার শেষ হলে আমাকে নিয়ে যাবি। বাজারের টাকা থেকে আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে যা।
জহির ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই এক লোক এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। থলথলে হুঁড়িওয়ালা এক লোক। এক হাতে চারটা মুরগি, অন্যহাতে বাজারের থলে। লোকটার পেছনে এক মিন্তি। মিন্তির মাথায় আঁকা ভর্তি কাঁচা বাজার। লোকটা জহির ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, ভালো আছেন?
জহির ভাই জবাব দিলেন না। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা বলল, আমার নাম আজিজুর রহমান খোকন। আমি চিত্রপরিচালক। দূর থেকে আপনাকে দেখে ভালো লেগেছে। আপনি কী করেন?
থুথু ফেলতে ফেলতে জহির ভাই বললেন, কিছু করি না।
রোল কী?
নায়কের বন্ধু।
জহির ভাই বললেন, আমাকে নায়কের বন্ধু করলে আপনার নায়ক মার খাবে। সেটা কি ঠিক হবে?
আজিজুর রহমান খোকন সাহেব বললেন, হাটে বাজারে তো এইসব আলাপ চলে না, আপনি একদিন অফিসে আসুন। আমার অফিস কাকরাইলে। সিনেমা পাড়ায়।
জহির ভাই বললেন, আমি অফিসে যাই না।
থোকন সাহেব বললেন, মোবাইল নাম্বার দেন আমি যোগাযোগ করব।
জহির ভাই বললেন, মোবাইল নাই। আচ্ছা শুনুন, আপনি তো ভালো বাজার করেন। মুরগি ভালো কিনেছেন। দুইটা মুরগি আমাদের দিয়ে যান। এতগুলো দিয়ে কী করবেন?
আজিজুর রহমান খোকন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন, বাবলু, উনার কাছ থেকে দুইটা মুরগি রেখে দে।
খোকন সাহেব বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, দুটা দিতে না চাইলে একটা দেন। সাদা গলার মুরগিটা দেন।
জোকারি কথাবার্তা বললেও জহির ভাই কিন্তু জোকার না। সিরিয়াস টাইপ মানুষ। খোকন সাহেবের কাছে সে যে মুরগি চেয়েছে জোকারি করে চায় নি, সত্যি সত্যি চেয়েছে।
জহির ভাইয়ের দুই হাজার টাকা সন্ধ্যার মধ্যে দরকার। অবশ্যই জরুরি কোনো কাজে দরকার। জরুরি কাজটা কী কে জানে? পনেরশ টাকার জন্যে আমি কার কার কাছে যাব তার লিস্ট করে ফেললাম। প্রথমে নীলা ফুপু, তারপর বড়খালা, তারপর মা, সবশেষে ভাইয়া।
নীলা ফুপু আমাকে দেখে প্রায় ছুটে এলেন। চোখ-মুখ শুকনা করে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? একটা চিঠি মগবাজারে দিয়ে আসতে একঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট লাগে? মুকুল ভাইকে পেয়েছিলি?
হুঁ।
চিঠি তার হাতে দিয়েছিস?
হুঁ।
চিঠি পড়েছেন?
হুঁ।
তোর সামনেই পড়ছেন?
হুঁ।
সব কথাতেই হুঁ হুঁ করছিস কেন? কথা বলা ভুলে গেছিস? চিঠি পড়ার পর মুকুল ভাই কিছু বলেছেন?
আমাকে বললেন, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিতে পারবে?
শুধু এইটুকু বলেছেন। আর কিছু বলেন নি?
না।
সিগারেট কিনে দিয়ে এসেছিস তো?
হুঁ।
উফ, লোকটা এত সিগারেট খায়! সারা শরীরে সিগারেটের গন্ধ।