আমি রান্নাঘরে ঢুকে বড়খালাকে চা পাঠাতে বললাম। খাবার টেবিলে নীলা ফুপুর পাশে এসে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে বল ভর্তি পাতলা পানি পানি খিচুড়ি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে দুধের মতো সর পড়েছে। আমি খিচুড়ি নিতে যাচ্ছি, নীলা ফুপু বললেন, খিচুড়ি নিস না। আজকের খিচুড়িতে প্রবলেম আছে।
কী প্রবলেম?
খিচুড়িতে একটা তেলাপোকা পাওয়া গেছে।
আমি হাত গুটিয়ে বসলাম। খিচুড়িতে তেলাপোকা পাওয়া আমাদের বাসার একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। হাঁড়ির যে অংশে তেলাপোকা পাওয়া গেছে, মা সেখান থেকে তেলাপোকা সুদ্ধ এক খাবলা খিচুড়ি শুধু ফেলে দেবেন। তারপর সূরা এখলাস পড়ে ফুঁ দিবেন। সূরা এখলাস পড়ে ফুঁ দিলে খাবার শুদ্ধ হয়ে যায়। মা না-কি কোনো এক ধর্মের বইয়ে পড়েছেন।
নীলা ফুপু বললেন, তোকে টাকা দিচ্ছি, তুই হোটেল থেকে গোশত পুরোটা খেয়ে আয়।
আমি বললাম, ইন রিটার্ন তোমার জন্যে কী করতে হবে সেটা বলো।
কিছুই করতে হবে না। দশ টাকায় তোর নাশতা হবে না?
হবে।
বসে থাক, আমি খাওয়া শেষ করে তোকে টাকা এনে দিচ্ছি।
নীলা ফুপু অকারণে টাকা খরচ করার মেয়ে না। আমাকে নাশতা খাওয়ানোর জন্যে তাঁর কোনো ব্যাকুলতা থাকার কথাও না। রহস্য কিছু আছে।
আমি সেই রহস্যের অপেক্ষা করছি।
বাবলু, এই নে তোর নাশতার টাকা। আর এই খামটা নে। জরুরি একটা চিঠি আছে, মুকুল ভাইয়ের হাতে দিবি। পারবি না?
পারব।
মুকুল ভাই কিন্তু এগারোটার পর বাসায় থাকেন না। এগারোটার মধ্যে যাবি। আর শোন, চিঠিটা খুবই জরুরি। অন্য কারো হাতে যেন না পড়ে।
চিঠিতে কী লেখা?
আছে কিছু ব্যক্তিগত বিষয়। তুই বুঝবি না।
নাশতা খেতে খেতে আমি ফুপুর চিঠি খুলে ফেললাম। অনেক কায়দা করতে হলো। চায়ের গরম কাপের সঙ্গে খামের মুখ চেপে ধরা। ব্লেড দিয়ে ঘষা। তারপরেও সমস্যা হলো— খামের মুখ সামান্য ছিঁড়ে গেল। এবং খামের গায়ে মাংসের ঝোল লেগে গেল।
এত ঝামেলা করে উদ্ধার করা নীলা ফুপুর চিঠিটা এরকম—
মুকুল ভাই,
আপনি কি ঐ দিনের ঘটনা কাউকে বলেছেন? অবশ্যই বলেছেন। না বললে রিয়া কী করে এমন একটা কথা বলল? রাগে-দুঃখে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছি। আমি অনেকবার মোবাইলে আপনাকে ধরার চেষ্টা করেছি। রিং হয়, কিন্তু আপনি ধরেন না। আমার ধারণা আমার নাম্বার দেখেই আপনি ধরেন না।
এখন রিয়া আমাকে কী বলেছে সেটা শুনুন। রিয়া টেলিফোন করে বলল, সোমবার শুটিং শেষ করে তুই গুলশানের কোনো রেস্ট হাউসে গিয়েছিলি? আমি বললাম, রেস্ট হাউসে কেন যাব? আমি বাসায় চলে এসেছি। তখন রিয়া বলল, আচ্ছা শোন, তোর কি সবুজ রঙ খুব পছন্দ? আমি বললাম, কী আবোল-তাবোল কথা বলছিস! সবুজ রঙের কথা আসল কেন? তখন রিয়া বলল, না, তোর আন্ডার গার্মেন্টসের কালার সবুজ— এই জন্যই রঙের কথা আসল।
আচ্ছা মুকুল ভাই, আমার আন্ডার গার্মেন্টসের কালার রিয়া কীভাবে জানল? আপনি কি সবাইকে সবকিছু বলে দিচ্ছেন?
চিঠিতে আমি সব কথা বলতে পারছি না। আপনাকে আমার আরো কথা বলার আছে। দয়া করে আমি যখন টেলিফোন করব তখন টেলিফোন ধরবেন। আপনি আমাকে আপনার বাসায় যেতে নিষেধ করেছেন বলে আমি যাই না। নিষেধ না করলে সরাসরি আপনার বাসায় চলে যেতাম।
মুকুল ভাই, আমাদের Next Lot-এর শুটিংয়ের ডেট কি হয়েছে? আমাকে কেউ কিছু জানায় না। এই লটে আপনি কি আমার ক্যারেক্টারটার দিকে একটু নজর দিবেন? গত এপিসোডে আমি শুধু একবার গ্লাসে দুধ নিয়ে ঢুকেছি। কোনো ডায়ালগ নাই। ডায়ালগ না থাকলে অভিনয়টা করব কীভাবে?
মুকুল ভাই, আপনি আমার ওপরে রাগ করবেন না। যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে থাকি তার জন্যে ক্ষমা করবেন।
ইতি
আপনার স্নেহধন্যা
নীলা
মুকুল ভাই বিশাল এক ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছেন। তার মাথার নিচে বালিশ। ইজিচেয়ারের হাতলে একটা গ্লাসে খুব সম্ভব অরেঞ্জ জুস। মাছি ভনভন করছে। মুকুল ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি রাতে ঘুমান নি। চোখ লাল। চোখের নিচে কালি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাঁর চেহারা পরিচিত কোনো মহাপুরুষের মতো। এখন নামটা মাথায় আসছে না। পরে নিশ্চয়ই আসবে।
তিনি হাই তুলতে তুলতে নীলা ফুপুর চিঠি পড়লেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, খামটা কি আগে ভোলা হয়েছে?
আমি বললাম, ভোলা হয়েছে কি-না জানি না। আমাকে যেমন দিয়েছে আমি নিয়ে এসেছি।
নীলা তোমার কে হয়?
ফুপু।
আপন?
জি।
ভেরি গুড। একটা কাজ করে দাও। ঘরে কোনো লোকজন নেই, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও। বেনসন। দেশীটা আনবে। সতুর টাকা প্যাকেট নিবে। সঙ্গে একটা ম্যাচ আনবে। পারবে না?
জি পারব।
মুকুল ভাই মানিব্যাগ হাতাহাতি করতে লাগলেন। একশ টাকার নোট খুঁজছেন। মানিব্যাগে একশ টাকার নোট নেই, সবই পাঁচশ টাকার নোট। মনে হয় তিনি আমাকে পাঁচশ টাকার নোট দিতে ভরসা পাচ্ছেন না।
তোমার নাম যেন কী? বাবলু।
পাঁচশ টাকার একটা নোট দিলাম। দুই প্যাকেট সিগারেট আর দুইটা ম্যাচ আনবে। দেরি করবে না। যাবে আর আসবে। সকাল থেকে সিগারেট খাই নি। ফুসফুস জ্যাম হয়ে আছে।
আমি পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে বাসায় চলে এলাম। একটু ভুল বললাম, বাসায় না, বাসার সামনেই ভিডিওর দোকান দি ইমেজে চলে এলাম। জহির ভাই বেশির ভাগ সময় এই দোকানেই বসে থাকেন। দোকানের মালিক ফারুক ভাই উনার জানি দোস্ত। দোকানে একটা পার্টিশান আছে। পার্টিশানের ওপাশে বড় ডিভান পাতা আছে। জহির ভাই এই ডিভানে শুয়ে ঘুমান কিংবা ম্যাগাজিনের ছবি দেখেন। যে-কোনো ম্যাগাজিনের নায়ক-নায়িকার ছবির দিকে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে পারেন।