আমি পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। ফুপা সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে রিস্টওয়াচ খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার হাতে ঘড়ি নাই, এটা আগে খেয়াল করি নাই। ঘড়িটা রাখ— একশ দেড়শ টাকার সস্তার ডিজিটাল ঘড়ি না। সাতশ লিরা দিয়ে কিনেছি।
আমি না না করতে যাচ্ছি, নীলা ফুপু আরেকটা ধমক দিলেন— আদর করে তোর ফুপা একটা জিনিস দিচ্ছে, না না করছিস কেন? একটাই তো তোর ফুপা!
ফুপা ঘড়ি দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, স্যুটের পকেট থেকে কলম বের করে আমার আমার বুকপকেটে দিয়ে দিলেন। দরাজ গলায় বললেন, পাস করার পর চিঠি দিও, তোমাকে ইটালি নিয়ে যাব। সেখানে সিটিজেনশিপের ব্যবস্থা করে দেয়ার দায়িত্ব আমার। যদি না পারি কান কেটে কুত্তাকে খাওয়ায়ে দিব। শামস উল আলম এককথার মানুষ।
ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে মেয়েরা শেষ কান্না কাঁদে। ফুপু সেই কান্না শুরু করলেন। ফুপা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন কাঁদে না লক্ষ্মী, কাঁদে না। প্রতি বছর একবার দেশে আসবে। মাই ওয়ার্ড অব অনার। ফুপা নিজেও কাঁদতে লাগলেন।
কী সুন্দর দৃশ্য! আমি চোখের সামনে তাঁদের অতি সুন্দর সংসার দেখতে পাচ্ছি। নীলা ফুপুর কুৎসিত অতীতের ছায়া এই সংসারে কোনোদিনও পড়বে না। আমাদের বাংলা স্যার বলতেন–জটিল অন্ধকারে কী হয়? সামান্য জোনাকির আলোতেও অন্ধকার কাটে। ফুপু এবং ফুপার ভালোবাসায় তাদের সব অন্ধকার কেটে যাবে।
ভাইয়ার রেজাল্ট হয়েছে। তিনি যথারীতি ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। এতেও তিনি সন্তুষ্ট না। একটা পেপারে না-কি কম নাম্বার পেয়েছেন। কেন কম পেয়েছেন এটা নিয়েই চিন্তিত। লেকচারার হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। এটা কোনো বড় কথা না। তার মতো ছেলে তো ইউনিভার্সিটির টিচার হবেই। বড় কথা হলো, মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাইয়া একটা গাড়ি কিনেছেন। মরিস মাইনর। গাড়ি এখনো রাস্তায় নামে নি। কারণ আমাদের ড্রাইভার নেই। ড্রাইভার খোঁজা হচ্ছে। ভাইয়া রোজই কারো না কারো ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন। কাউকেই তার মনে ধরছে না। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি গাড়ির পেছনে ব্যয় করেন। পালকের ঝাড়ন দিয়ে ধুলা ঝাড়েন। হোস পাইপে পানি দিয়ে গাড়ি ধোয়া হয়। একদিন তিনি গাড়ি কীভাবে চলে, ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে, স্পার্ক প্লাগ কী, এইসব নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। পেট্রোল ইঞ্জিনের সঙ্গে স্টিম ইঞ্জিনের তফাতটা কোথায়? রকেটের ইঞ্জিন কী? আমি সব জেনে গেলাম।
বড়খালার ভূত দেখা রোগের আরো উন্নতি হয়েছে। আগে ভূতগুলো থাকত খাটের নিচে, এখন তারা সাহসী হয়েছে। গভীর রাতে খালা যখন টিভি দেখেন তখন তারা খাটের নিচ থেকে বের হয়ে আসে, খালার সঙ্গে টিভি দেখে চুপচাপ টিভি দেখলে ঝামেলা ছিল না, কিন্তু তারা নিজেদের পছন্দের প্রোগ্রাম দেখতে চায়। খালা হয়তো নাটক দেখছেন, তারা ফস করে রিমোট টেনে অন্য চ্যানেল দিয়ে দিবে। ভূতরা খালার জীবন অস্থির করে তুলেছে।
ভাইয়ার পরামর্শে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট খালার চিকিৎসা করছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট বলছেন খালার রোগের নাম ডিলুশান অব পারসেপশন। রোগটা তার শুরু হয়েছে খালু সাহেবের মৃত্যুর পর। কারণ খুঁজতে গিয়ে মজার একটা জিনিস বের হয়েছে, খালু সাহেব তার বিপুল বিষয়-সম্পত্তি, ব্যাংকের ক্যাশ টাকার অতি সামান্য অংশই খালাকে দিয়ে গেছেন। সবই জহির ভাইয়ের নামে। খালা এতদিন তা চেপে রেখেছেন। এই কাজটা খালু সাহেব কেন করেছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ নিশ্চয়ই আছে। সব ঘটনার পেছনে কারণ থাকবে। ভাইয়া যেমন বলেন, প্রথমে Cause তারপর Effect।
এর মধ্যে আমি একবার বাসার কাউকে না বলে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে বাবাকে দেখে এসেছি। বাবাকে তারা ঢাকা থেকে কুমিল্লা পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে দেখা করার পুরো ব্যবস্থাটা করে দেয় ওসি সাহেবের ছেলে শামসুল। শামসুল সবসময় খেলাধুলা নিয়ে থাকলেও এসএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো করে। জিপিএ ফাইভ পায়। শামসুলের কাছে শুনেছি তার বাবা ছেলের রেজাল্টের খবর শুনে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে বলেন, হে আল্লাহপাক, আমি আমার জীবনের সবচে ভালো সংবাদটা শুনে ফেলেছি। এখন আমার মৃত্যু হলেও কোনো আফসোস নাই।
শামসুল আবার এই অংশটা অভিনয় করে সবাইকে দেখায়। এত সুন্দর অভিনয়! শামসুল ক্রিকেট না খেলে অভিনয় করলে অনেক ভালো করত। জোকারি অভিনয়। সে সবচে ভালো অভিনয় করে পাগলের। নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট বাথরুম করার সময় পাগল কী করে সেই অভিনয়। এমনিতে পাগলদের লজ্জাবোধ নেই শুধু ছোট বাথরুম করার সময় পাগলরা নাকি লজ্জায় মরে যায়।
একটা ছোট্ট জানালা
একটা ছোট্ট জানালা। জানালার একপাশে বাবা, অন্যপাশে আমি। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে পারেন। তা তিনি করছেন না। মাথা নিচু করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছেন। প্রথম কথা কে বলবে? তিনি বলবেন, না আমি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমিই প্রথম কথা বললাম।
বাবা, কেমন আছ?
তিনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই তো লম্বা হয়ে গেছিস রে। মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ।
বাবা, তোমার জন্য সিগারেট এনেছি।
আমি তিন প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট কাউন্টার দিয়ে এগিয়ে দিলাম। তিনি আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট নিতে নিতে বললেন, কাজটা ঠিক হয়। নাই। ছেলে বাবার জন্য সিগারেট আনবে— এটা কেমন কথা!